অবশেষে ১২ বছর পর বাড়ি ফিরলেন সুমন
১২ বছর আগে চাকরির উদ্দেশে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে গিয়েছিলেন লক্ষ্মীপুরের যুবক মো. সুমন। এর মধ্যে একবারের জন্যও তিনি বাড়ি ফেরেননি। অবশেষে মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) বিকেলে ইন্ডিগো এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে ওমান থেকে তিনি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে নামেন। তবে তিনি ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন। বাড়ির ঠিকানা বলতে না পারায় তাকে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে রাখা হয়।
এরপর, ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ারে কর্মরত কয়েকজন সুমনকে নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। খোঁজ পেয়ে পরিবারের লোকজন তাকে সেখান থেকে বাড়ি নিয়ে আসেন। সুমনকে ওমানে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে বলে ধারণা করছে তার পরিবার।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মানসিক ভারসাম্য না থাকায় সুমন বিমানবন্দরে নেমে অস্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করছিলেন। বিষয়টি এভিয়েশন সিকিউরিটি ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের নজরে আসে। তিনি বাড়ির ঠিকানা বলতে পারছিলেন না। তার সঙ্গে পাসপোর্ট বা অন্য কোনো কাগজপত্রও ছিল না। পরে এভিয়েশন সিকিউরিটি ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় তাকে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। ব্র্যাক মাইগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ফেসবুকে তার স্বজনদের খোঁজ চেয়ে স্ট্যাটাস দেন। সেই স্ট্যাটাস নজরে পড়ে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দার। তারা তাকে চিনতে পেরে পরিবারের লোকজনকে বিষয়টি জানান।
বিজ্ঞাপন
সুমনের বাবা হাফিজ উল্যাহ ফেসবুকে ছেলের ছবি দেখে চিনতে পারেন। পরে তিনি বড় ছেলে মো. মামুনকে বিষয়টি জানান। মামুন রাতেই ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে মোবাইলফোনে কথা বলেন। বুধবার (২৭ আগস্ট) সকালে বিস্তারিত তথ্য দিয়ে সুমনের পরিচয় নিশ্চিত করেন ভাই মামুন। বেলা ১১টার দিকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের অ্যাসোসিয়েট ডিরেক্টর শরিফুল ইসলামের উপস্থিতিতে মামুনকে তার কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিকেল ৫টার দিকে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের অ্যাম্বুলেন্সে করে তিনি লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার রতনপুর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছান। তাকে দেখতে বাড়িতে ছুটে এসেছেন দুই বোন সুমি আক্তার ও সুইটি আক্তার। এ ছাড়া ছোট ভাই মুরাদ হোসেন চট্টগ্রাম কর্মস্থল থেকে ভাইকে দেখতে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন বলে জানা গেছে।
সুমনের বাবা হাফিজ উল্যাহ, মা নাজমুন নাহার ও ভাই মিজান জানান, সুমন লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার মান্দারী ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের আসলাম দর্জি বাড়ির বাসিন্দা। তারা চার ভাই ও দুই বোন। সুমন পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। প্রায় ১২ বছর আগে চাকরির উদ্দেশে সুমন ওমান যান। প্রথম দিকে তিনি একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। পরে সেখানে তিনি একটি টেইলার্সের দোকান দেন। ২০১৫ সালে সুমন তার ভাই মো. মিজানকে ওমানে তার দোকানে চাকরির উদ্দেশে নিয়ে যান। সেখানে দুই বছর কাজ করে মিজান দেশে চলে আসেন। এরপর সুমন সেখানে একটি বোরকার দোকানও দেন। নিয়মিত বাড়িতে যোগাযোগ ছিল তার। এরমধ্যে তার দোকানগুলোও হাতছাড়া হয়ে যায়। তবে কি হয়েছে বাড়িতে তিনি কিছুই বলেননি। এরপর প্রায় আট মাস ধরে তিনি বাড়িতে যোগাযোগ করেন না। সবশেষ ২০২৪ সালের রমজান মাসে টাকা পাঠিয়েছেন বাড়িতে, এরপর আর টাকা পাঠাননি বলে জানিয়েছেন তার বাবা।
প্রতিবেশী মো. শাহজাহান বলেন, কয়েক মাস ধরে সুমনের কোনো খোঁজ-খবর ছিল না। কী হয়েছে, তাও জানতাম না। মঙ্গলবার রাতে এলাকার কয়েকজন ফেসবুকে তার ছবি দেখে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তার দেশে আসার ঘটনাটি আমাদেরকে জানান।
সুমনের ভাই মিজান বলেন, আমি ওমানে ভাইয়ার দোকানে দুই বছর ছিলাম। এরপর চলে আসি। তার ব্যবসা ভালোই ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, কেউ ভাইয়াকে সেখানে টর্চার করেছে। বাংলাদেশিরাই ঘটনাটি ঘটাতে পারে। ভাইয়া সঠিকভাবে কিছু বলতে পারছেন না। স্বাভাবিক হলে তার সঙ্গে কথা বললে হয়তো বিষয়টি সম্পূর্ণ জানা যাবে।
জানতে চাইলে সুমন বলেন, ওমানে সমস্যা হয়েছে। তবে কী হয়েছে, এ ব্যাপারে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না।
সুমনের বড় ভাই মো. মামুন বলেন, সুমন প্রথমে আমাকে দেখে চিনেছে। তবে আমার অন্য ভাই মিজানকে তাৎক্ষণিক চিনতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, সে ওমানে মানসিক ও শারীরিকভাবে টর্চারের শিকার হয়েছে।
আরও পড়ুন
সুমনের মা নাজমুন নাহার বলেন, ছেলে বাড়িতে এসেছে, এতেই আমি খুশি। দীর্ঘ ১২ বছর পর তাকে দেখতে পেয়েছি, এর চেয়ে শান্তি আপাতত কিছু হতে পারে না। দোয়া করবেন ছেলেটি যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে।
সুমনের বাবা হাফিজ উল্যাহ বলেন, সুমন এসএসসি পাসও করতে পারেনি। পরে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ধারদেনা করে তাকে আবুধাবি পাঠাই। সেখানে ৫ মাস থেকে মাত্র ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল। পরে বাড়ি থেকে ধার করে ৩০ হাজার টাকা পাঠালে সে চলে আসে। এরপর এক বছর সে বাড়িতে ছিল। মানুষের ধারদেনা পরিশোধ করতে পারিনি। কারণ আমিও কৃষি কাজ করে সংসার চালাতাম, উপার্জন করার মতো আর কেউ ছিল না সংসারে।
হাফিজ উল্যাহ আরও বলেন, ধারদেনা পরিশোধ না করেই পুনরায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা ধার করে তাকে ওমানে পাঠাই। সেখানে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে নিজের সব ধারদেনা পরিশোধ করি। এরমধ্যে দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। সুমন ছাড়া অন্য তিন ছেলে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বিভিন্ন পেশায় কাজ করছে। এরমধ্যে সেজ ছেলে মিজানকে ওমান নিয়ে যায় সুমন। দুই বছর সেখানে থেকে মিজান দেশে চলে আসে। এখন সে ঢাকায় ওয়েল্ডিংয়ের কাজ করে। ওমানে সুমনের দুটি দোকান ছিল, পরে দোকানগুলো তার হাতছাড়া হয়ে যায়। কীভাবে কী হয়েছে, কখনো সে কিছু বলেনি।
নোয়াখালী (এমআরএসসি) সেক্টর স্পেশালিস্ট-ইকোনমিক রিইন্টিগ্রেশন নাহিদ জুলফিকার বলেন, প্রায়ই মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় অনেক প্রবাসী দেশে ফেরেন, যাদের স্বজনদের খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। গত আট বছরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ১৪৮ জনকে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। শুধু ২০২৪ সালেই ৪০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এ সময় ৩৭ হাজারেরও বেশি প্রবাসীকে সহায়তা দিয়েছে ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টার।
হাসান মাহমুদ শাকিল/এএমকে