১৯৯৮ সালে ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র পরিবারের জন্য পাবনার সুজানগরের ভায়না ইউনিয়নে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বেশ কয়েকটি ঘর নির্মাণ করা হয়। এরপর ২৬ বছর পার হলেও কোনো সংস্কার করা হয়নি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোতে। 

ঘরের টিনগুলো মরিচা ধরে খসে পড়ছে। পলিথিন ও পাটখড়ি দিয়ে কোনোরকমে ঘরগুলোর কাঠামো ঠিক রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি, একটুখানি বাতাস হলেই ঘর নড়বড় করে। কোনো মতে জোড়াতালি দিয়ে বসবাস করছেন সেখানকার বাসিন্দারা।

বুধবার (২৭ আগস্ট) সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো পলিথিন ও পাটখড়ির দিয়ে ডেকে রাখা হয়েছে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এগুলো এক সময় সরকারি পাকা ঘর ছিল। ইট-বালু খুঁটির ওপর লোহার সঙ্গে থাকা টিন মরিচা ধরে খসে পড়ায় ঘর থেকে খোলা আকাশ দেখা যায়। কোনো মতে পাটখড়ি ও পলিথিনের জোড়াতালি দিয়ে বসবাস করছেন স্থানীয় কিছু দরিদ্র পরিবার। মেঝের পলেস্তারা উঠে মাটি বের হয়ে গেছে। ভেঙে গেছে চারপাশের বেড়া ও সিমেন্টের খুঁটি। বৃষ্টির পানি ঠেকাতে দেওয়া হয়েছে পলিথিনের ছাউনি। এমনই জরাজীর্ণ ও বসবাসের অনুপযোগী আশ্রয়ণ (ব্যারাক) প্রকল্পের ঘর। দেখে মনে হচ্ছে কোনো মরুভূমি বা গহীন জঙ্গলে মানুষজন আশ্রয়ের জন্য ঘর বানিয়েছে।

‎প্রকল্পের বাসিন্দা ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৮ সালে ছিন্নমূল ও হতদরিদ্র পরিবারের জন্য ভায়না আশ্রয়ণ প্রকল্পটি (ব্যারাক) তৈরি করা হয়। উপজেলার ভায়না ইউনিয়নে রাস্তার পাশে নির্মিত সরকারি এ আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোতে মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে দরিদ্র কিছু পরিবারের। নির্মাণের পর আর কোনো মেরামত করা হয়নি। ফলে দিনে দিনে নষ্ট হতে থাকে ঘরগুলো। মরিচা পড়ে ক্ষয় হয়ে গেছে টিন। ভেঙে গেছে সিমেন্টের খুঁটিগুলো। বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়লেও বিকল্প কোনো আশ্রয় না থাকায় দরিদ্র পরিবারগুলো বাধ্য হয়েই এখানে বসবাস করছেন। বৃষ্টির দিনে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয় তাদের। এমন কোন ঘর নেই যে, বৃষ্টি হলে ঘরে পানি না পড়ে। তাই কেউ কেউ ঘরের চালার সাথে পলিথিন দিয়ে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থাও করেছে।

‎সংস্কারের অভাবে এ ঘরগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত হলেও এসব ঘর মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে আতঙ্কে দিন কাটছে বসবাসকারী দরিদ্র অসহায় পরিবারগুলোর। তাদের দাবি, ভাঙাচোরা ঘরের চালায় পলিথিন দিয়ে ফুটো বন্ধ করে কোনো রকম বসবাস করে আসছেন তারা। অন্যত্র সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়েই পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা ও অস্বাস্থ্যকর এ ঝুঁকিপূর্ণ ঘরে বসবাস করছে এসব পরিবার।

‎এখানকার বাসিন্দা শ্রীমতি ববি বালা বলেন, এখানে যে কিভাবে বসবাস করি একমাত্র ভগবানই জানেন। সামান্য বৃষ্টি হলেই পানিতে ভরে যায় ঘরের মেঝে। হালকা ঝড় হলেই পলিথিন ও পাটখড়ি উড়ে যায়। আবার সেগুলো দিয়ে মেরামত করে থাকতে হয়। আসলে আমরা বছরের পর বছর এমন অবস্থায় থাকলেও কারও চোখে পড়ে না। ভোটের সময় এলে ভোটে দাঁড়ানো লোকজন এসে সংস্কারের আশ্বাস দিয়ে যায়। নির্বাচনের পর আর কোনো খবর থাকে না। 

‎আরেকজন রসাই হোসেন বলেন, খেয়ে না খেয়ে এই দুর্ভোগের মধ্যে বসবাস করছি বাবা। আমাদের দেখার মতো কেউ নেই। মনে হয় আমরা কোনো জঙ্গলে বসবাস করতেছি। কোনো মতো বসবাসের অধিকারটুকুও আমাদের নেই। কত চেয়ারম্যান মেম্বর এলো গেল কেউ চোখে দেখেনি। কোনদিন কেউ অনুদানও নিয়ে আসেনি।  বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের এই জরাজীর্ণের মধ্যেই থাকতে হচ্ছে। 

‎স্থানীয় বাসিন্দা ইউনুস আলী বলেন, দূর থেকে দেখলে মনে হবে এটি একটি মরুভূমির ভেতরে বসবাসের জন্য ছাউনি। অথচ প্রায় ২৬ বছর আগে ইট বালি সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল পাকা ঘরগুলো। এদের কষ্ট দেখে আমাদেরও খুব খারাপ লাগে। কিন্তু আমাদের তো সাধ্য নেই। মাঝেমধ্যে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। তাদের আশ্বাসেই সীমাবদ্ধ থাকত। অনেকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা এখানে বসবাস করেন না। রাত হলেই ভুতূড়ে পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এখন যেহেতু নতুন বাংলাদেশ তাই এগুলো সংস্কার করে বসবাসের উপযোগী করে তোলার তাবি করেন তিনি।

‎তৎকালীন সুজানগরের ভায়না ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আলহাজ্ব আজম আলী বিশ্বাস বলেন, আমি সে সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। বিগত প্রায় ২৬ বছরেও এখানকার কোনো ঘর সংস্কার করা হয়নি। যদি সংস্কার না করা হয় তাহলে বছরের পর বছর এভাবেই কষ্ট সহ্য করে থাকতে হবে। সরকারের কাছে দ্রুত সংস্কার করে বসবাসের উপযোগী করার দাবি করেন তিনি।

‎ভায়না ইউনিয়র পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান আমিন উদ্দিন বলেন, তারা খুবই অসহায় হয়ে আছে। অনেকে ঘর ছেড়ে দিয়ে অন্য কোথায় চলে গেছে। যারা থাকেন তারা কষ্ট মেনে নিয়েই থাকেন। তবে এগুলো সংস্কার হওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি।

‎সুজানগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মীর রাশেদুজ্জামান রাশেদ বলেন, বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমেই জানতে পেরেছি। অর্থ বরাদ্দ পেলে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হবে জরাজীর্ণ ঘরগুলো। সীমাহীন কষ্টের মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে এসব বাসিন্দাদের। বিষয়টি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে দেখছি। 

‎রাকিব হাসনাত/আরকে