ভরা মৌসুমেও পদ্মা ও মেঘনা নদীতে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশের দেখা। জেলেরা দিন-রাত নদী চষে বেড়ালেও জ্বালানি খরচ উঠছে না তাদের। এ কারণে পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে তাদের। ইলিশ সংকটের কারণে পদ্মা-মেঘনার তীরবর্তী মাছের আড়তগুলোতেও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার পথে। ইলিশের এমন সংকটের কারণ হিসেবে মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, নদীতে চর জেগে ওঠা, তলদেশে খাদ্য সংকট ও নদীর পানি দূষণসহ অন্যান্য কারণে ইলিশের সংকট দেখা দিয়েছে এ বছর।

সাধারণত বছরের জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ইলিশের ভরা মৌসুম থাকে। তবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসকে বিশেষভাবে ভরা মৌসুম বলা হয়। কারণ এই সময়ে ইলিশ মাছ বেশি পরিমাণে ধরা পড়ে, বিশেষ করে আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমায় এরা ডিম ছাড়ার জন্য সাগরে থাকে।

গত এক সপ্তাহ শরীয়তপুরের পদ্মা-মেঘনার জেলে ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বর্ষার স্রোতে টইটম্বুর পদ্মা-মেঘনার পানি। চারদিকে মৎস শিকারি জেলেদের নৌকার আনাগোনা। কিন্তু এ দৃশ্যের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে দীর্ঘশ্বাস। কারণ ভরা মৌসুমেও জেলেদের জালে উঠছে না কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশ। সারাদিন নদীতে জাল ফেলে শিকার হয় মাত্র কয়েকটি ইলিশ। এতে জেলেদের জ্বালানি খরচসহ খোরাকিই হয় না। অন্যদিকে, মৌসুমে বেশি ইলিশের আশায় মহাজনের কাছ থেকে দাদন নিয়েছিলেন যেসব জেলেরা, তাদের ঋণের বোঝা ক্রমশ বেড়েই চলছে। ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে এমন তথ্যই জানিয়েছেন জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার জেলেরা।

নদী পাড়ের আড়তগুলোতে দেখা গেছে শুনশান নিরবতা। কয়েক ঘণ্টা পর পর নৌকা তীরে ভীরলে আশায় বুক বাঁধে আড়তদার। কিন্তু নদীতে টানা ১০-১২ ঘণ্টা জাল ফেলে ৪ থেকে ৫টি ইলিশ নিয়ে আসে ৮ থেকে ১০ জনের একটি জেলে নৌকা। জ্বালানিসহ অন্যান্য খরচ তুলতে জেলেরা আড়তদারদের কাছে চড়া দাম হাঁকেন। চড়া দামে মাছ ক্রয়ের পরে পাইকাররাও চড়া দামে তা কিনে নিয়ে যায়। আড়ৎদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে এক কেজি ইলিশের দাম ছিল ১ হাজার ৫০০ টাকা। এখন সেই একই ইলিশের দাম ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা।

শরীয়তপুর জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, নড়িয়ার সুরেশ্বর থেকে গোসাইরহাটের কোদালপুর ৪০ কিলোমিটার এলাকা ইলিশের বিশেষ অঞ্চল বলে চিহ্নিত। এ ছাড়া, জেলার ৮০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ইলিশ পাওয়া যায়। জেলায় মৎস্যজীবী রয়েছে ২৯ হাজার ৩৬৭ জন। জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে ২৭ হাজার ৩১৩ মেট্রিক টন। কিন্তু মাছ উৎপাদন হয় ৩০ হাজার ১৯২ মেট্রিক টন। উদ্বৃত্ত থাকে ২ হাজার ৮৭৯ মেট্রিক টন।

বছরে দুইবার অর্থাৎ জাটকা এবং মা ইলিশ সংরক্ষণ সময়ে ৭ হাজার ১৫০ জন জেলে পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি করে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া, এসব জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন উপকরণ দেওয়া হচ্ছে। এ বছর ইলিশ উৎপাদন কমে যাওয়ার পেছনে পানি দূষণ, অবৈধ জাল ব্যবহার, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং জলবায়ু পরিবর্তন উল্লেখযোগ্য কারণ। নদীর নাব্যতা সংকট এবং ইলিশের খাদ্যের অভাবও মাছের সংখ্যায় প্রভাব ফেলছে।

গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর লঞ্চ ঘাট এলাকার আড়তদার মো. সালালউদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। তিনি বলেন, ইলিশের আমদানি না থাকায় অনেক আড়ত বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। এই আড়তে আগে অনেক বেচাকেনা হতো সেই তুলনায় এখন বেচাকেনা নেই বললেই চলে। হঠাৎ এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তা সবার কল্পনার বাইরে ছিল। জেলেদের জালে যেই ইলিশ ধরা পড়ছে তা বিক্রি করে আড়তের ঋণ পরিশোধ করার সামর্থ্য তাদের নেই। নদীতে এমন ইলিশ শুন্য থাকলে অনেক পরিবার পথে বসবে।

একই এলাকার জেলে কালাম উদ্দিন মোল্লা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নৌকায় ১০ জন জেলে মিলে নদীতে দিনরাত মাছ ধরি। ১০-১২ ঘণ্টা পরিশ্রম করে ইলিশ পাই ২-৩ হাজার টাকার কিন্তু আমাদের খরচ হয় তার থেকে অনেক বেশি। গত বছরের তুলনায় এই বছর নদীতে ইলিশ নেই বললেই চলে। গতবার নদীতে এক খেও দিলেই ১০-১২ হাজার টাকার ইলিশ পেতাম। এ বছর তিন খেও দিলেও ১০ হাজার টাকার ইলিশ পাই না। গতবছর দুই মাসে ৩-৪ লাখ টাকা ইলিশ বিক্রি করতে পেরেছি কিন্তু এবার বিভিন্ন খরচ দিয়ে ১০ টাকাও ইনকাম করতে পারিনি। আড়তদার থেকে লাখ লাখ টাকার দাদন নিয়ে নদীতে নেমেছি এখন এই দাদনের টাকা কিভাবে পরিশোধ করব এই চিন্তায় আছি।

ভেদরগঞ্জ উপজেলার নরসিংহপুর আলুর বাজার ফেরি ঘাটের জেলে ইকবাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভোর থেকে আমরা পাঁচজন জেলে এই দুপুর পর্যন্ত পরিশ্রম করে ছোট-বড় পাঁচটি ইলিশ পেয়েছি। বিক্রি করেছি ১ হাজার ১০০ টাকা। এতে আমাদের জ্বালানি খরচও ওঠেনি। বাড়িতে চাল-ডাল এখন কষ্ট করে কিনতে হয়। কীভাবে সামনে দিনে চলবে, তা ভাবলে ঘুম আসে না।

নড়িয়া উপজেলার সুরেশ্বর ঘাটের জেলে মো. সৈয়ব গাজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, গতবছর দুই মাসে প্রতি নৌকায় ৩-৪ লাখ টাকা করে কামাই হইছে। সেই তুলনায় এবছর নদীতে ইলিশ মাছ একবারেই নেই। এজন্যই আমাদের জেলেদের না খাওয়া অবস্থা। কিন্তু আমরা রাত দিন ২৪ ঘণ্টা নদীতে মাছ ধরে সকালে আড়তে এসে মাছ বিক্রি করি ৩-৪ হাজার টাকা। এইজন্য অনেক জেলে মাছ ধরতে আসে না অন্য কাজে চলে যায়। এবছর দাদনের টাকাও পরিশোধ করতে পারবো না। ইঞ্জিন এবং নৌকা খরচ ও হয় না।

শরীয়তপুর জেলা (ভারপ্রাপ্ত) মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কাশেম ঢাকা পোস্টকে বলেন, শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ ও গোসাইরহাট উপজেলার বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে পদ্মা-মেঘনা নদী। এ বছর আমরা লক্ষ্য করছি এবং জেলেদের থেকে জানতে পেরেছি নদীতে ইলিশ সংকট। তবে আমরা আশাবাদী, আমাদের যে মা ইলিশ সংরক্ষণ করার সময় সূচি, তার আগেই নদীতে পর্যাপ্ত সংখ্যক ইলিশ আসবে এবং জেলেরা ইলিশ শিকার করতে পারবেন। এ ছাড়া নদী দূষণ, নাব্যতা ইত্যাদি কারণে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ পর্যাপ্ত পরিমাণ মাছ উৎপাদন করতে পারে না, ফলে ইলিশ সংকট দেখা দিয়েছে। তবে এখনও যে সময় আছে, তাতে ইলিশ নদীতে আসবে।

নয়ন দাস/এএমকে