আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের দু’বছর পার হলেও অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে রংপুর বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স। রক্ষণাবেক্ষণসহ ক্রীড়া কার্যক্রম পরিচালনায় দীর্ঘ সময়েও জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অভিভাবকহীন এতিম শিশুর মতো অবস্থা ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ক্রীড়া কমপ্লেক্সের। উদ্বোধনের আগে এই কমপ্লেক্সে একটি মাত্র ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়েছিল, যা নিয়েও রয়েছে নানা অভিযোগ।

জানা যায়, রংপুর বিভাগের আট জেলার নারীদের খেলাধুলার প্রসার, উন্নয়ন ও বিকাশে ২০১৭ সালে ১০ একর জমির ওপর রংপুর মহানগরীর উত্তম এলাকায় ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেয় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রংপুর জিলা স্কুল মাঠে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী জনসভা থেকে এই ক্রীড়া কমপ্লেক্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। যদিও বিশাল এই বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের নির্মাণকাজ শেষ হয় আরও চার মাস পরে অর্থাৎ ডিসেম্বরে। 

উদ্বোধনের আগে ২০২২ সালে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ‘বিভাগীয় কমিশনার কাপ মহিলা ফুটবল টুর্নামেন্ট' এর আয়োজন করা হয়েছিল এই আধুনিক কমপ্লেক্স মাঠে। এ টুর্নামেন্টে রংপুর বিভাগের ৮ জেলার নারী ফুটবল দল অংশ নিয়েছিল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের খেলা গড়ায়নি এই কমপ্লেক্সে। এমনকি কাউকে দেখানো হয়নি এই কমপ্লেক্সে কী ধরনের ক্রীড়া সরঞ্জাম রয়েছে। ক্রীড়াবিদদের পদচারণাহীন কমপ্লেক্সেটি সময়ের ব্যবধানে গোচরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রংপুর বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সের সাজানো, গোছানো জিমের দামি সরঞ্জামে পড়েছে ধুলার আস্তরণ। যত্রতত্র পড়েছে শ্যাওলা, ভবনে ধরেছে ফাটল।  বিশাল খেলার মাঠ, ইনডোর, হোস্টেল, অফিস ও কনফারেন্স রুম থাকলেও নিয়োগ হয়নি কোনো জনবল। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভবনগুলো দেখা গেলেও ভেতরে কেবলই শূন্যতা। চাক বেধেছে মৌমাছি। ব‍্যবহার না করায় ইনডোর ও জিমনেশিয়ামের কোটি টাকার সরঞ্জাম নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বিশাল এই কমপ্লেক্সটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৮ কোটি টাকা।

‎স্থানীয় এলাকাবাসী রশিদ মিয়া বলেন, অনেকদিন থেকে অবহেলায় পড়ে আছে। কেউ আসে না, কোনো খেলাধুলা হয় না। এজন্য গেটে ধান শুকাচ্ছি। অযত্ন অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা দেখার কেউ নাই। ভেতরে সাপ, মৌমাছির চাক দিয়ে ভর্তি হয়েছে। ভবনের সব কোটি কোটি টাকার জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে বিকল হয়ে পরে আছে অনেকদিন থেকে।

‎আরেক স্থানীয় বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, দীর্ঘ ৯ বছর হয়ে গেল এখানে কেউ আসেও নাই, খেলাও হয় নাই। সম্ভবত একটা টুর্নামেন্টের খেলা দেখছি। এছাড়া কোনদিন এই জায়গায় কোনো খেলা হতে দেখিনি। পরিত্যক্ত অবস্থায় সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। 

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা বিভাগীয় শহরে বাস করি, অথচ সরকার আমাদেরকে বিভাগীয় শহরের মানুষ হিসাবে মূল্যায়ন করে না। আমরা সবসময় বঞ্চিত হচ্ছি। এত বড় একটা কমপ্লেক্স বছরের পর বছর ধরে অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। কোটি কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। অথচ কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। কিছুদিন আগে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা রংপুর স্টেডিয়ামে এসেছিলেন, তিনিও আমাদের এই কমপ্লেক্সের খোঁজ নেননি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক সাবেক জনপ্রতিনিধি বলেন, রংপুর বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণ হওয়ায় সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে তৎকালীন সরকারের লোকজন। বিশেষ করে রংপুর বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বিসিবির সাবেক পরিচালক অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল ইসলাম এই কমপ্লেক্সের জমির বন্দোবস্ত করতে গিয়ে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এখনো অনেক মানুষ আছে যারা জমি অধিগ্রহণের ন্যায্য মূল্য পায়নি। তারা আগেও ভয়ে কথা বলেননি, এখনো অজ্ঞাত কারণে মুখ খুলছেন না। অথচ অনুসন্ধান করলে ৩৮ কোটি টাকার এই ক্রীড়া কমপ্লেক্সের আড়ালে কারা কারা অনিয়ম দুর্নীতি করে সরকারের টাকা লুটপাট করেছে সবই বের হয়ে আসবে। তিনি অবিলম্বে এই কমপ্লেক্স নির্মাণ কমিটিসহ সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে সরকার ও দুদককে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।

‎এদিকে ক্ষোভ জানিয়েছেন ক্রীড়াবিদরা। তারা বলছেন, সরকার এটি তো ফেলে রাখার জন্য নির্মাণ করেননি। তাহলে বছরের পর বছর ধরে জনবল নিয়োগের অযুহাতে কেন এটি পড়ে থাকবে। এটি তৈরিতে যে কোটি টাকা খরচ হয়েছে, দৃশ্যপটে এখন বলতে হবে এটি লুটপাটের প্রকল্প ছিল, এই অপচয়ের দায় কী সরকার স্বীকার করবে?

নারী ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন ‎সাবেক খেলোয়াড় ও কোচ আরিফা জাহান বীথি। নারীদের ক্রীড়া প্রতিভার বিকাশ ও ক্রীড়ানুরাগী জনগোষ্ঠী গড়ার লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুলছেন উইমেন্স ড্রিমার ক্রিকেট একাডেমি এণ্ড হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন। সাবেক এই খেলোয়াড় বলেন, রংপুর বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে অনেক বড় ইনডোর সুবিধা আছে। মেয়েদের থাকার ব‍্যবস্থা আছে। অথচ বছরের পর বছর ধরে এটি ফেলে রাখা হয়েছে। কেন, কি কারণে এই কমপ্লেক্সের প্রতি, এই অঞ্চলের মানুষের প্রতি অবহেলা, তা জানি না। আমার কাছে মনে হয়েছে ওখানে সরকারের পুরো টাকাটায় ক্ষতি হয়েছে। কারণ ওখানে খেলাধুলার সবকিছু ব‍্যবস্থা থাকলেও সুযোগ সুবিধা আর জনবলের অভাবে পুরোটাই এখন ধ্বংসের পথে।

কবে দরজা খুলবে, কবে জনবল নিয়োগের মধ্যদিয়ে ক্রীড়াবিদদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠবে রংপুর বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স, এখন সেটি দেখার অপেক্ষায় খেলোয়াড়, সংগঠক ও সচেতন মহল।  ‎এ বিষয়ে বরাবরের মত দায়সারা উত্তর মিলছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।

রংপুর বিভাগীয় মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স কমিটির বর্তমান সদস্য সচিব সেলোয়ারা বেগম বলেন, কিভাবে আমরা প্রোগ্রাম হাতে নিতে পারি, কিভাবে কাজ করবো সেটার একটি মিটিং হবে। আমরা আশা করছি কিছুদিনের মধ্যে একটা মিটিং কল করতে পারব। মিটিং কল কিভাবে এই এলাকার মেয়েদের জন‍্য কাজ করা যায় সেটা আমরা হাতে নেব। যদিও পদাধিকার বলে বিভাগীয় কমিশনারে স্ত্রী আহ্বায়ক। উনি আসলে তার সঙ্গে কথা বলব। এটা অবহেলায় পরে থাকাটা দুঃখজনক। বিগত বছরগুলোতে কেন এরকম হলো সেগুলো ক্ষতিয়ে দেখা হবে। তবে খুব দ্রুত আমরা মিটিং করে একটা সিদ্ধান্ত নেব।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরকে