যুবদল কর্মী শামীম হত্যা
‘আমি যেন স্বামী হত্যার বিচার পাই’
ইনসেটে নিহত রফিকুল ইসলাম শামীম
নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার গন্ডা ইউনিয়নের মনকান্দা গ্রামের বিলের একটি ডোবা থেকে এক ব্যক্তির গলিত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পরে মরদেহটি ময়নাতদন্তের জন্য নেত্রকোণা সদর হাসাপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। মরদেহটি তিন মাস আগে নিখোঁজ সাবেক ছাত্রদল নেতা রফিকুল ইসলাম শামীমের বলে দাবি করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা।
এর আগে শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় স্থানীয়দের খবরের ভিত্তিতে মরদেহটি উদ্ধার করা হয়। কেন্দুয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বিজ্ঞাপন
নিহত রফিকুল ইসলাম শামীম কেন্দুয়া থানার ৫ নংগন্ডা ইউনিয়নে ছাত্রদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। বর্তমানে তিনি যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।
সরেজমিনে স্থানীয় লোকজন ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২ জুলাই রাত সাড়ে ১১টার দিকে ইউনিয়নের পাহাড়পুর এলাকা থেকে শামীম রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হন। নিখোঁজের পর পরিবারের লোকজন থানায় অভিযোগ করতে গেলে তাদের অভিযোগ আমলে নেয়নি থানা পুলিশ। গত সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে তার বাড়ির পাশে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
শামীমের পরিবারের লোকজন বলছে, স্থানীয় এমইউ আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ পদ নিয়ে একটি বিরোধ তৈরি হয় শামীমের সঙ্গে। মূলত প্রিন্সিপাল পদে যিনি ছিলেন তিনি মোটা অংকের ঘুষ লেনদেন করেছিলেন কয়েকজন স্থানীয় প্রভাবশালীর সঙ্গে, যা মেনে নেননি শামীম। যার কারণে শামীমকে প্রথমে গুম করা হয়েছে এবং পরে তাকে হত্যা করে বিলের পানিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
উপজেলার এমইউ আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মহিবুল্লাহকে পুনর্বহাল ও ঘুষ বাণিজ্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে সম্প্রতি প্রতিপক্ষের গুম-খুনের হুমকির শিকার হন মনকান্দা গ্রামের শামীম। এ ঘটনার দুই দিন পর রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হন শামীম। পরে পরিবারের লোকজন বারবার কেন্দুয়া থানায় গিয়ে মামলা করতে চাইলেও পুলিশ নানা অজুহাতে মামলা নেয়নি বলে অভিযোগ ভুক্তভোগী পরিবারের।
শামীমের বাবা আক্কাস আলী বলেন, মাদরাসার প্রিন্সিপাল স্থানীয়দের সাথে খারাপ ব্যবহার করায় গ্রামবাসী তাকে তার পদ থেকে অপসারণ করে। পরবর্তীতে মাদরাসার দায়িত্ব নেন ভাইস প্রিন্সিপাল সাইফুল ইসলাম। পরে স্থানীয় কয়েকজনের সাথে যোগসাজশ করে সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রিন্সিপালকে তার পদে পুনরায় বহাল করার চুক্তি করেন। কিন্তু সেটি মেনে নেয়নি শামীম। সাইফুল ইসলাম, শহীদ মোড়ল ও আলী ওসমান মেম্বার এই তিনজন মিলে চুক্তি করেন। কিন্তু আমার ছেলে এটার প্রতিবাদ করে, যার কারণে এরা সবাই মিলে আমার ছেলেকে হুমকি দেয় তাকে গুম করবে, হত্যা করে ফেলবে। এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজন ও নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি দরবার করা হয়। সেই দরবারের সিদ্ধান্ত হয়, পরবর্তী দরবারের দিন সাড়ে ১৬ লাখ টাকা ফেরত দিতে হবে। কিন্তু তার আগেই তারা আমার ছেলেকে গুম করে ফেলে।
নিহতের বড় ভাই মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই নিখোঁজ হওয়ার পর আমরা বারবার থানার দ্বারস্ত হয়েছি মামলা করার বিষয়ে। কিন্তু তারা বারবার আমাদের ফিরিয়ে দিয়েছে মামলা না নিয়েই। পরবর্তীতে আমরা বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা করি। মামলা করার পরও পুলিশ বিষয়টিকে সিরিয়াসলি নেয়নি। তারা বারবার বলার পরেও আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমরা বারবার চেষ্টা করে অপারগ হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছি। এখন প্রায় তিন মাস পরে আমার ভাইয়ের লাশ আমাদের পাশের বিলে পাওয়া গিয়েছে কঙ্কাল অবস্থায়। তার চেহারা চেনার কোনো উপায় নেই, আমরা তার পরনের কাপড় দেখে তাকে শনাক্ত করেছি।
স্থানীয় বিএনপি নেতা সুজন মিয়া বলেন, রফিকুল ইসলাম শামীম নিখোঁজ হওয়ার প্রায় তিন মাস পর তার মরদেহ বিরানদুরী বিলে পাওয়া গেছে। শামীম গুম হওয়ার পেছনে একমাত্র কারণ ছিল সে অন্যায়ের প্রতিবাদ করত, মানুষের উপকার করত। এটাই তার মৃত্যুর মূল কারণ। আমাদের দেশনেতা তারেক রহমানকে অনুরোধ করে বলবো- আপনি বলেছিলেন মিছিলের শেষে থাকা লোকটা তার রাজনৈতিক পরিচয় পাবে। আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করে বলছি, নিখোঁজ শামীমের বিষয়টি একটু সুনজরে নেবেন। শামীমকে যারা খুন করেছে তাদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। সে ব্যবস্থা আপনি করবেন, এটাই আপনার কাছে কর্মী হিসেবে দাবি।
উপজেলার গন্ডা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল আলম ভূঁইয়া রনি বলেন, শামীম নিবেদিত প্রাণ একজন কর্মী ছিলেন। তাকে এভাবে গুম করার পর হত্যার বিষয়টি আমরা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না সে একজন সৎ ও প্রতিবাদী মানুষ ছিল। যে বা যারা তাকে এভাবে হত্যার পেছনে আছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।
গন্ডা ইউনিয়ন যুবদলের সদস্য সচিব মেহেদী হাসান সুজন ঢাকা পোস্টকে জানান, শামীম একজন প্রতিবাদী ও ন্যায়পরায়ণ লোক ছিল। সে সবসময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন ছিল। এলাকায় যত ধরনের অন্যায় হতো সে প্রথমে তার প্রতিবাদ করত। সম্প্রতি একটি মাদরাসার অধ্যক্ষের পদ নিয়ে ঝামেলা তৈরি হওয়ার পর তার এই পরিণতি হয়েছে। আমি দলের একজন কর্মী হিসেবে এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
তিনি আরও বলেন, আমি মাদরাসার অধ্যক্ষ মহিবুল্লাকে যতটুক চিনি তিনি ভালো মানুষ না। এমনকি অনেকের কাছেই শুনেছি তার বিভিন্ন অপকর্মের বিষয়ে। প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে অধিকতর তদন্তের দাবি জানাচ্ছি।
নিহত শামীমের স্ত্রী নাজমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্বামী নিখোঁজ হওয়ার প্রায় তিন মাস পার হয়েছে। গতকাল তার লাশ পাওয়া গেছে। এখন আর তার আশায় বসে থেকে কোনো লাভ নেই। আমার স্বামীকে যারা প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে গুম করবে, হত্যা করবে, আমি তাদের সঠিক বিচার চাই। যে চলে গেছে তাকে তো আর ফিরে পাব না। কিন্তু আমি প্রশাসনের কাছে এই হত্যাকাণ্ডের সঠিক বিচার দাবি করছি। তারেক রহমানের কাছে আমার অনুরোধ আমি যেন স্বামী হত্যার বিচার পাই। আমার ৮ বছরের একটি ছেলে রয়েছে। আমার পেটে শামীমের অনাগত যমজ সন্তান। তারা পৃথিবীতে আসলে আমি তাদের কী জবাব দেব। তাদের কীভাবে বলব তাদের বাবাকে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ প্রশাসনের কাছে গিয়েও কোনো সহযোগিতা পাইনি। তাদের কাছে বারবার গিয়েছি, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। তারা আমাকে ডেকে নিয়ে বলেছে, আমরা নাকি তাকে লুকিয়ে রেখেছি। তারা আমাকে হুমকি দিয়েছে, যেন আমি স্বীকার করি যে আমার স্বামীকে আমরা লুকিয়ে রেখেছি। পুলিশ কীভাবে আমাকে এ ধরনের কথা বলে? সব কিছুর পরে আমার একটাই চাওয়া, আমি যেন আমার স্বামী হত্যার বিচার পাই।
এ বিষয়ে কথা বলতে এমইউ আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ এএমএম মুহিববুল্লাহর সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। এমনকি তাকে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
থানায় মামলা গ্রহণ না করা ও হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে কেন্দুয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, হয়রানির বিষয়টি সঠিক নয়। নিখোঁজের পরদিন তারা আসলে আমরা তাদের জিডি নিয়েছি। তাদেরকে মামলার বিষয়ে আমরা বলেছি, কিন্তু তারা দেবে দেবে বলে মামলা করেনি। পরবর্তীতে তারা বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে মামলা করেছে এবং ১ নং আসামিকে আমরা গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছি। বাকি আসামি যারা রয়েছে তারা উচ্চ আদালত থেকে ছয় সপ্তাহের আগাম জামিন নিয়েছেন। আমরা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে শামীমের নিখোঁজ সংক্রান্ত যে মামলা রয়েছে সেটি দেখছি।
চয়ন দেবনাথ মুন্না/আরএআর