বিশ্ব শিক্ষক দিবস
ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে হাতে তুলে নিয়েছিলেন চক
১৯৭২ সালে জনতা ব্যাংকের সঙ্গে শুরু হয় যাত্রা। কিন্তু তা ছিল কয়েকদিনের জন্য। পারিবারিক সিদ্ধান্ত ও এলাকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ব্যাংকের নিরাপদ চাকরি ছেড়ে চক হাতে তুলে নিয়েছিলেন মো. রুহুল আমীন ভূঞা। ৩৭ বছরের সেই যাত্রায় হয়ে উঠেছেন জনপদের প্রেরণা, এক আলোকবর্তিকা।
মো. রুহুল আমীন ভূঞা ১৯৪৭ সালে ফেনী পৌরসভার ৮ নম্বর ওয়ার্ড বারাহীপুর এলাকার ভূঞা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। শিক্ষাজীবনে ফেনী মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ফেনী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও ফেনী টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে বিএড শেষ করেন রুহুল আমীন ভূঞা। ১৯৭৪ সালে ফেনীর শহীদ মেজর সালাহ উদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। তারপর অল্প সময়ের ব্যবধানেই তাকে দেওয়া হয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব।
বিজ্ঞাপন
শিক্ষকতা জীবনের শুরুর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে রুহুল আমীন ভূঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষক হিসেবে এ বিদ্যালয়ে যোগদানের সময় যে প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি স্বল্প বেতন-ভাতায় চাকরি করতে চাননি। তখন বিদ্যালয়ের সভাপতি সদর থানা সার্কেল কর্মকর্তা (বর্তমানে ইউএনও) সবার পরামর্শে আমাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেন। তারপর থেকে টিনের ঘরে শতাধিক শিক্ষার্থী নিয়ে ফেনীর উত্তরের এ জনপদে নতুন করে সব শুরু করি। তখন শহর কেন্দ্রীক সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, জিএ অ্যাকাডেমি, সেন্ট্রাল ও মডেল উচ্চ বিদ্যালয় ছাড়া আমতলী, ফতেহপুর বা বারাহীপুরের এদিক আর কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না।
তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর অর্থনৈতিক ও শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক থেকে কাজ করা অনেকটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। তবুও অল্প সময়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ কয়েকজন শিক্ষককে বিদ্যালয়ে নিয়োগ দিয়ে ধীরে ধীরে পরিবর্তনের সূচনা করি।
বিজ্ঞাপন
বিদ্যালয় পরিচালনায় নিজের কর্মদক্ষতার কথা উল্লেখ করে রুহুল আমীন ভূঞা বলেন, দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে মন্ত্রীপাড়া, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় মানুষজনের অকুণ্ঠ সহযোগিতা ছিল। তা না হলে অল্প বয়সী এক ছেলে দায়িত্ব নিয়ে এতো কাজ করা সম্ভব হতো না। এ সময়ে তৎকালীন মন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীর বিক্রম, শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, এ এস এইচ কে সাদেক ও শেখ শহীদুল ইসলামসহ অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিরা এ বিদ্যালয়ে এসেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতাও করেছেন। পরবর্তীতে টিনের ঘর থেকে একটি বিজ্ঞান ভবন, দোতলা ভবন, সীমানা প্রাচীরসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন কাজ বাস্তবায়ন করেছি। সবশেষে হাজার শিক্ষার্থী রেখে অবসরে গিয়েছি।
বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৩৭ বছরের প্রধান শিক্ষকতার যাত্রায় সহকর্মী থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী, কখনো কেউ আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেনি। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-কর্মচারী সবাই খুব মান্য করতো। এ বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে আমার অনেক কৃতি শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন জায়গায় উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে, অনেকে চাকরি থেকে অবসরে গেছেন।
বর্তমান আর তখনকার শিক্ষকতা পেশায় কোনো পার্থক্য খুঁজে পান কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে এই গুণী শিক্ষক বলেন, তখনকার ছেলে-মেয়েরা অনেক বেশি অনুগত ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ে যে পরিবর্তন সেখানে অভিভাবকদের খামখেয়ালি রয়েছে। একজন গৃহশিক্ষক থেকে যে কোনো পর্যায়ের শিক্ষককে সম্মান করতে হবে। অন্যথায় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের পাঠদানও কাঙ্খিত হবে না।
তিনি আরও বলেন, শুধু চেয়ারে বসে থেকে কাজ করিনি। প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিজেই নিয়মিত ক্লাস ভিজিট করতাম। বিভিন্ন সময় শ্রেণি কক্ষের পেছনে বসে শিক্ষকদের পাঠদানে নজর দিয়েছি। আন্তরিকতা ও সম্মান দিয়ে শিক্ষকদের ত্রুটি সমাধানে কাজ করতাম। কারণ এসব দেখেই একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বড় হয়। এসব কর্মকাণ্ড যথাযথ ও ইতিবাচক হলে সেই প্রতিষ্ঠানের ছেলে-মেয়েরাও আদর্শবান হবেন। কর্মজীবনে জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হয়েছিলাম। দীর্ঘ সময় স্কাউটের কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছি। শিক্ষকতার পাশাপাশি ১৯৯৫ সাল থেকে লায়ন্স পরিবারের সঙ্গে যাত্রা শুরু করি। সর্বশেষ ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত লায়ন্স ক্লাবের (ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫ বি২ বাংলাদেশ) প্রধান উপদেষ্টা ছিলাম।
নিজের ব্যক্তিগত জীবন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যক্তিগত জীবনে এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। ছেলে ফেনী থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক। এ ছাড়া, মেয়ে স্বামীর সঙ্গে রাজধানীতে বসবাস করছেন। আমার স্ত্রী ২০১৯ সালে প্রয়াত হয়েছেন। পারিবারিক দায়িত্ব থেকেও সব নিজের জন্য না রেখে ভাইদের কর্মসংস্থানের বিষয়েও নজর দিয়েছি।
অবসর জীবনের কথা তুলে ধরে মো. রুহুল আমীন ভূঞা বলেন, আমার আর কোনো চাহিদা নেই। ২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে অবসর-পরবর্তী জীবন শুরু। সময় কাটাতে কিছুটা কষ্ট হয়। অন্যথায় সবমিলিয়ে ভালো আছি। আগে বিভিন্ন ধরনের বই পড়া হলেও এখন আর সেদিক সময় দেওয়া হয় না। বর্তমানে অর্থসহ কোরআন শরিফ, বুখারী ও মুসলিম শরিফ—এ তিনটিতেই সময় কাটছে। এককথায় বলব, পৃথিবী শেখার জায়গা। যত দেখবে, তত শিখবে। প্রতিটি বৃক্ষ থেকেও শেখার আছে। নিজেকে ভালোবাসতে হবে, নিজের গ্রামের মানুষদের সঙ্গেও মিশতে হবে।
আরও পড়ুন
বাবা হিসেবে এ গুণী শিক্ষকের বিষয়ে জানতে কথা হয় তার একমাত্র ছেলে আরিফুল আমিন রিজভীর সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, স্কুল ছিল বাবার প্রাণ। এর বাইরে কোনো কিছুই তিনি মন দিয়ে ভাবতেন না। শিক্ষকতার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসার দাপ্তরিক বিষয় দেখভাল করলেও কখনো এসবে মন দিতে চাইতেন না। আমরা ভাইবোন কখন কোন শ্রেণি অতিক্রম করেছি, তাও তিনি মনে করতে পারতেন না। সবমিলে বাবা একজন আদর্শ অভিভাবক। কেবল স্ত্রী-সন্তানের জন্য নয়, এখনো নিজের ছোট দুই ভাইকে নিয়ে ওনার বৃহৎ সংসার।
শহীদ মেজর সালাহ উদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, রুহুল আমীন স্যার আমার জীবনে দেখা অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। ওনার দায়িত্বকালেই বিদ্যালয়টি বেড়ার ঘর থেকে ইট-পাথরের স্থায়ী ভবনে রূপ নেয়। বিদ্যালয়ের বর্তমান কাঠামোর অধিকাংশই স্যারের হাতে গড়া। ফেনীর উত্তরাঞ্চলের বারাহীপুর, ধর্মপুর, চাঁড়িপুর ও সুলতানপুরসহ বিস্তৃত এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। নির্লোভ, নিরহংকার ও সৎ জীবনযাপন ওনাকে শিক্ষার্থীদের কাছে এক বিশেষ সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
এ প্রসঙ্গে ফেনীর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আসাদুজ্জামান দারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছোটবেলা থেকেই ওনাকে একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষাগুরু হিসেবে চিনি। জীবনের বড় একটি সময় তিনি শিক্ষাদানে ব্যয় করেছেন। এখনো লায়ন্সসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। এ অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে ওনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এএমকে