প্রেসক্রিপশনের সবগুলো ওষুধও কিনতে পারছেন না শিক্ষক হাবিবুর
সরু গেটের ওপর বাগান বিলাসে ছেঁয়ে থাকলেও কোনো ফুল নেই গাছটিতে। গেট দিয়ে ঢুকতেই টিনের জরাজীর্ণ বাড়িতে ভাঙা চৌকির পাশে বসে ছিলেন এক সময়ের গুণী ও মার্জিত সকলের প্রিয় শিক্ষক হাবিবুর স্যার। ফুল গাছটির মতোই তার অবস্থা। বয়সের ভারে ন্যুব্জ অসুখ-বিসুখে আক্রান্ত এই শিক্ষকের ওষুধ কেনারও সামর্থ্য এখন নেই। প্রেসক্রিপশনে একাধিক ওষুধ লেখা থাকলেও ডায়াবেটিস ও প্রেসারের ওষুধ খেয়ে কোনোমতে দিন পার করছেন তিনি।
৫ অক্টোবর (রোববার) বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘শিক্ষক সম্মান ও ডিজিটাল যুগের শিক্ষা উন্নয়ন।’ দিবসটিতে শিক্ষকরা কেমন আছেন তা জানতে শনিবার (৪ অক্টোবর) কথা হয় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. হাবিবুর রহমানের সঙ্গে। যশোরের ঝিকরগাছার পারবাজারে দুই রুমের এই বাড়িতেই পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে বসবাস করছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক হাবিবুর। ২০১২ সালে তিনি উপজেলার কাশিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে অবসরগ্রহণ করেছেন।
বিজ্ঞাপন
১৯৭৩ সালে যশোর আমিনিয়া আলিয়া মাদরাসা থেকে শিক্ষা জীবন শেষ করে ওই বছরই ঝিকরগাছার কুলবাড়িয়া এবতেদায়ী মাদরাসায় যোগদানের মধ্যদিয়ে শিক্ষকতা পেশা শুরু করেন তিনি। এ সময় তার সম্মানী ছিল মাত্র ৮০ টাকা। এরপর শার্শার বাগআঁচড়া ছিদ্দিকীয়া ফাজিল মাদরাসায় যোগ দেন। পরে ১৯৭৯ সালে ঝিকরগাছার কাশিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মৌলভী শিক্ষক হিসেবে ২৩৫ টাকা বেতনে শিক্ষকতা শুরু করেন।
২০১২ সালে ১২ হাজার টাকা বেতনে অবসরে যান তিনি। এরপর শুরু হয় অবসরকালীন ভাতাপ্রাপ্তির যুদ্ধ। একপর্যায়ে বছর তিনেক পর ২ লাখ ৬২ হাজার টাকা কল্যাণ তহবিল ও দ্বিতীয় ধাপে প্রায় ৪ লাখ টাকা অবসরবোধ ভাতা পান। তবে তিন বছরের জীবনযুদ্ধে ধার-দেনায় সেই কল্যাণ তহবিল ও অবসরভাতা চোখে দেখেননি তিনি। পরে সংসার চালাতে গিয়ে শুরু করেন ইমামতি। সেই থেকে ঝিকরগাছার কাউরিয়া শেখপাড়ার জামে মসজিদে ইমামতি করছিলেন। ২০২৪ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এখন স্বাভাবিকভাবে চলতে-ফিরতে পারেন না এই শিক্ষক।
বিজ্ঞাপন
জরাজীর্ণ বাড়ি ও ভিটার সাত শতক জমি ছাড়া আর কোনো সম্পদ নেই হাবিবুর রহমানের। পারিবারিক জীবনে তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক তিনি। এক সময় ভালোভাবেই চলছিল তার সংসার। বড় ছেলে চাকরি করছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অকালে বড় ছেলে মৃত্যুবরণ করেন। আবারও শুরু হয় অভাবের জীবন। বাকি দুই ছেলে সামান্য মজুরির কাজ করেন। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তবে নাতনি তার পরিবারেই মানুষ হচ্ছে। জীবনের শেষ সময়ে এসে মজুর দুই ছেলের ওপর এখন পুরোদমে নির্ভরশীল শিক্ষক হাবিবুর।
৪০ বছর ধরে শিক্ষকতা করা হাবিবুর রহমান বলেন, সারা জীবন শিক্ষাদান করেছি। শেষ বয়সে এসেও জীবনযুদ্ধ শেষ হয়নি। স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন হাবিবুর। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, যখন শিক্ষকতা করেছি তখন এক অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে দেখেছি স্কুলে স্কুলে গিয়ে সাহায্য তুলেছেন। তখন ভেবেছি আমিও তো শিক্ষক। আমার অবস্থাও সেই একই। পারছি না হাত পাততে, আবার পারছি না সংসারের হাল ধরতে। এক প্রকার সংসারের বোঝা হয়ে গেছি।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ৯০ দশকে আমাদের প্রতিষ্ঠানে মন্ত্রণালয় থেকে অডিটে এসেছিল। তার চাহিদা অনুযায়ী ৭ হাজার না দিয়ে ৬ হাজার টাকা দেওয়ায় তিনি তা মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। একজন ৩০০ টাকা বেতনধারী শিক্ষকের কাছ থেকেও টাকার জন্য মন্ত্রণালয়ের অডিটর সেদিন যে ব্যবহার করেছিলেন তা আমার হৃদয়ে দাগ কেটে রয়েছে।
হাবিবুর রহমানের ছোট ছেলে এহসানুল কবির সাকি বলেন, বাবার প্রতিদিন অনেক টাকার ওষুধ লাগে। অভাবের সংসারে আমরা যতদূর পারি সংগ্রহ করে দেওয়ার চেষ্টা করি। বাবা এখন অনেক কিছুই মনে রাখতে পারেন না। বর্তমানে তার ভালো চিকিৎসা জরুরি।
হাবিবুর রহমানের ছাত্র কাশিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের করনিক মো. রবিউল ইসলাম বলেন, হাবিবুর স্যার একজন গুণী শিক্ষক। মার্জিত শিক্ষক হওয়ায় তিনি সকলের নিকট প্রিয় ছিলেন। অবসর জীবনে তার এমন পরিণতি হবে আমরা কখনও ভাবিনি।
হাবিবুর রহমানের ছাত্র বর্ণী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মোশাররফ হোসেন বলেন, একদমই শান্ত স্বভাবের শিক্ষক ছিলেন আমাদের ইসলাম শিক্ষার শিক্ষক হাবিবুর রহমান স্যার। তিনি অত্যন্ত মিশুক ছিলেন বিধায় আমরা সকলে তার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশতাম। তিনি সব সময় আমাদেরকে নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রজীবনে একাধিকবার তার বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আমাকে তিনি তার সন্তানের মতো করে দেখতেন। তার শিক্ষা এবং কর্মকাণ্ডে উজ্জীবিত হয়ে আজ এ পর্যায়ে আসতে পেরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজেকে গড়তে পেরেছি বলে মনে করছি। স্যারের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞতা থাকবে।
হাবিবুরের সহকর্মী অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গোবিন্দ মজুমদার বলেন, তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। ইসলাম ধর্মের একজন শিক্ষক হয়েও আমার মতো একজন হিন্দু ধর্মালম্বীর সঙ্গে তার মনের মিল হয়েছিল। ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে আমার একজন ভাই হিসেবে তিনি নিজেকে পরিচিত করেছিলেন। তার মতো মানুষ এ জগতে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর।
তিনি বলেন, শিক্ষক হাবিবুরের মনে ব্যথা ছিল। সেই ব্যথা হলো নিজের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষিত না করতে পারার ব্যথা। হাবিবুর স্যার প্রায়শই বলতেন, আমি একজন শিক্ষক। তবে আমার সন্তানদের সেভাবে উচ্চ শিক্ষিত করতে পারলাম না। এই ব্যথা আমাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, আমার চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে মারা গেছে। দুই ছেলের এক ছেলে আইএ পাস। ছোট ছেলেটা এসএসসি পরীক্ষা দিল না। মেয়েটা ডিগ্রি পর্যন্ত পড়েছে। তারপর বিয়ে হয়েছে।
ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া করাতে না পারায় নিজের ব্যর্থতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমার সর্বোচ্চ দিয়ে আমি চেষ্টা করেছি ওদের লেখাপড়া করানোর জন্য। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য। তবে শেষ পর্যন্ত তা পারিনি।
ঝিকরগাছা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন সোহাগ বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাতে এখনও বৈষম্য রয়েছে। একজন সরকারি শিক্ষক যে পরিমাণ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন আমরা বেসরকারি শিক্ষকরা তার ছিটেফোটাও পাই না। হয়তো ভবিষ্যতে হাবিবুর স্যারের মতো আমাদের অবস্থাও অপেক্ষা করছে। মানবিক দিক বিবেচনায় সরকারের এসব বিষয়ে নিয়ে ভাবা উচিৎ বলে মনে করি।
এমএএস