ফরিদপুরের নগরকান্দার সেই পা দিয়ে লিখে এইচএসসি পাস করা দুই হাতহীন জসিম মাতুব্বরের (২৬) দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। অবশেষে তিনি বুঝে পেয়েছেন বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি)।

বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) বিকেল ৫টার দিকে নগরকান্দা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দবির উদ্দিন উপজেলার লস্করদিয়া ইউনিয়নের কালীবাড়ি বাজারে অবস্থিত জসিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে তাকে এনআইডি কার্ড বুঝিয়ে দেন।

এনআইডি হাতে নিয়ে স্বয়ং ইউএনও তার দোকানে এসেছেন দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন জসিম। কিছু সময়ের জন্য হতচকিত হয়ে যান তিনি।

সেই মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে জসিম মাতুব্বর বলেন, “আমি স্বপ্নেও ভাবিনি ইউএনও স্যার আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষের দোকানে আসবেন। যেখানে কার্ড আনতে আমার যাওয়ার কথা ছিল ইউএনও অফিসে, সেখানে স্যার এসেছেন আমার এই ছোট্ট দোকানে।”

জসিম আরও বলেন, “স্যারের সঙ্গে নির্বাচন অফিস, রাজনৈতিক দল ও সাংবাদিকসহ আরও অনেকে এসেছিলেন। আমার দোকানে সবার বসার জায়গাও ছিল না। বিস্ময়ে আমি তাৎক্ষণিকভাবে কী করব বা কীভাবে স্যারকে স্বাগত জানাব, কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। টাকা না থাকায় আপ্যায়ন করার কথাও বলতে পারিনি। অথচ উনি আমার জন্য এত কষ্ট করেছেন! যে কার্ডের জন্য আমি বছরের পর বছর ঘুরেছি, সেটিই ইউএনও স্যার জানার পর ১৬ দিনের মধ্যে হয়ে গেল।”

জসিম বলেন, জন্ম থেকে দুই হাত না থাকায় জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। অনেক জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু এনআইডি পাইনি। আজ ইউএনও স্যার আমার দোকানে এসে নিজ হাতে কার্ডটি দিয়েছেন—এটা আমার জীবনের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। আমি স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ। আজ নিজের এনআইডি পাওয়ায় মনে হচ্ছে জীবনের বড় একটি অর্জন হলো।

এর আগে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ইউএনও দবির উদ্দিনের উদ্যোগে জসিমকে উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে নেওয়া হয়। সেখানে তার চোখের আইরিশের ছবি এবং পায়ের মাধ্যমে স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। পরে দ্রুত কাগজপত্র নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়।

গত ৫ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে একটি বার্তায় জসিমকে জানানো হয়, ‘অভিনন্দন জসিম মাতুব্বর, আপনার এনআইডি নম্বর হয়ে গেছে।’ পরে ইউএনও জসিমের কার্ডটি ডাউনলোড করে আজ তার হাতে তুলে দেন।

জসিমের দীর্ঘদিনের আশা পূরণ করতে পেরে নিজেও আনন্দিত ইউএনও দবির উদ্দিন। তিনি বলেন, “মিডিয়ার মাধ্যমেই জসিমের সমস্যার কথাটি আমি প্রথম জানতে পারি। তার গল্প পড়ে খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। দুই হাত না থাকা সত্ত্বেও সে নিজের যোগ্যতায় এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছে, এখন ডিগ্রিতে পড়ছে। তার মতো একজন মেধাবী তরুণ যেন শুধু এনআইডি না থাকার কারণে পিছিয়ে না পড়ে, সেটি নিশ্চিত করতে চেয়েছি। এ কাজটি করতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত। এই ঘটনাটি আমার জীবনে আনন্দের এক ফল্গুধারা হয়ে থাকবে। দেশের যেখানেই কাজ করি না কেন, আমি মানুষের কাছে অদম্য জসিমের গল্প বলে বেড়াব।”

ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার কদমতলী গ্রামের হানিফ মাতুব্বর ও তসিরণ বেগমের ছেলে জসিম জন্ম থেকেই দুই হাতহীন। পা দিয়ে লিখেই পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। পড়াশোনার পাশাপাশি অভাবের সংসারে নিজের খরচ চালাতে হাটে সবজি ও ফল বিক্রি করেন অদম্য এই তরুণ। চার ভাইয়ের সংসারে তিনি বড়। পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি সংসারেও আর্থিক সহায়তা করেন তিনি।

তার জীবনের এই কঠিন লড়াইয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) না থাকা। হাত না থাকায় আঙুলের ছাপ দিতে না পারায় তিন বছর ধরে আবেদন করেও কার্ড পাননি জসিম।

জহির হোসেন/আরকে