শারমিনের সয়াফুড এখন বিদেশেও জনপ্রিয়
দেশে উৎপাদিত তেলজাতীয় ফসল সয়াবিন দিয়ে আগে শুধু পোল্ট্রি, মাছ ও গরুর খাদ্য তৈরি হতো। তবে এখন এই সয়াবিন দিয়ে মুখরোচক ও পুষ্টিকর খাবার তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের নারী শারমিন আক্তার (৩৫)। সয়াল্যান্ড খ্যাত মেঘনা উপকূলীয় এই জেলায় তিনি তৈরি করছেন সয়াবিনভিত্তিক ৫০ রকমের খাবার। ঢাকার অভিজাত ফুডশপ থেকে শুরু করে দেশের বাইরেও তার তৈরি খাবারের কদর বাড়ছে।
এই পুষ্টিকর খাবারগুলো সয়াফুড নামে পরিচিত। তার খাদ্য তৈরির খবরে নেদারল্যান্ডসের কয়েকজন নাগরিক পর্যন্ত ছুটে এসেছেন তার বাড়িতে। শারমিনের এ উদ্যোগে যেমন তার পরিবার স্বচ্ছলতা পেয়েছে, তেমনি কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে স্থানীয় নারীদের জন্য।
বিজ্ঞাপন
শারমিন লক্ষ্মীপুর জেলার কমলনগর উপজেলার চর কাদিরা ইউনিয়নের চরঠিকা গ্রামের বাসিন্দা। তার স্বামী ইলেকট্রিশিয়ান মাসুম বাঘা বিভিন্নভাবে তাকে সহায়তা করে যাচ্ছেন। তাদের বড় মেয়ে মায়ের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে কৃষি নিয়ে স্নাতক পড়ছেন। মেজো মেয়ে মাদরাসায় আলিম শ্রেণিতে এবং ছোট মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।
শারমিনের অধীনে বর্তমানে ২৫ জন নারী কাজ করছেন। প্রতি সপ্তাহে চার দিন তারা সয়াফুড ঢাকায় পাঠান। মাসে কয়েক লাখ টাকার খাবার বিক্রি হয়। তৈরি খাবারগুলোর মধ্যে রয়েছে- সয়া তফু, সয়া প্রোটিন বল, সয়া দুধ, সয়া কাবাব, সয়া দই, সয়া পায়েস, সয়া সস, সয়া আটা, সয়া বিস্কুট, সয়া রোল, সয়া মিষ্টি, সয়া জিলাপি, সয়া পরোটা, সয়া সন্দেশ, সয়া বোরহানি, সয়া সমুচা, সয়া সিঙ্গারাসহ মোট ৫০ ধরনের পণ্য। কিছু পণ্যের দাম স্বাভাবিক, আবার কিছু পণ্যের দাম কিছুটা বেশি হলেও, মান ও পুষ্টিগুণের কারণে এগুলোর চাহিদা বাড়ছে।
বিজ্ঞাপন
নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন শারমিন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এসএসিপি প্রকল্প ও একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার পক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সয়াবিনভিত্তিক খাবার তৈরির প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তিনি।
সয়াফুড কারিগর মনিরন বেগম ও পাইনুর বেগম জানান, তারা প্রতিদিন ৪০০ টাকা মজুরি পান, সঙ্গে দুপুরের খাবারও দেওয়া হয়। শারমিনের উদ্যোগে তারা পরিবারে আর্থিকভাবে অবদান রাখতে পারছেন।
শারমিন বলেন, আগে সয়াবিন শুধু হাঁস-মুরগি, গরু ও মাছের খাবার ছিল। কিন্তু গত ৭-৮ বছরে আমি এটি দিয়ে মুখরোচক খাবার তৈরি করে মানুষের পাতে তুলে দিতে পেরেছি। এখন আমার তৈরি সয়াফুডের একটি ব্র্যান্ড হয়েছে। এরই মাধ্যমে আমার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, তার তৈরি অন্তত ৩০টি খাবার ঢাকার অভিজাত ফুডশপে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিদেশিরাও এসব খাবারের ভোক্তা। তার তৈরি তফু চীন, জাপান, কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের নাগরিকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
বর্তমানে ঢাকার অভিজাত চেইন ফুডশপ ‘ফৌজিয়া হেলদি ফুড’ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘সলিডারিডাড’-এর মাধ্যমে তার পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে ইউনিমার্ট, আগোরা ও ফুডপান্ডায়।
আরও পড়ুন
খাবারের মূল্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে শারমিন জানান, ২০০ গ্রাম তফু ৪৫ টাকা, প্রতিটি প্রোটিন বল ৬ টাকা, ৩৫০ গ্রাম সয়া বিস্কুট ১০০ টাকা, ১০ পিস পরোটা (৭০০ গ্রাম) ৮০ টাকা, ৬০০ গ্রাম রুটি ৭৫ টাকা, প্রতি পিস সন্দেশ ১৫ টাকা এবং সয়ারোল প্রতিটি ৫০ টাকায় সরবরাহ করা হয়। তবে প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্যাকেজিং ও পরিবহন খরচ শেষে ভোক্তার কাছে এসব পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে যায়।
শারমিন, পাপিয়া ও রুপানা জানান, ৫০-৫৫ টাকার এক কেজি সয়াবিন থেকে প্রায় ১ হাজার ৭০০ টাকার খাবার তৈরি করা সম্ভব। এসব খাবারের চাহিদা বাড়লে কৃষকদের উৎপাদিত সয়াবিনের মূল্যও বাড়বে। এতে বিপুল কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে, কারণ সয়াফুড এখন বিদেশিদেরও পছন্দের খাবারে পরিণত হয়েছে।
শারমিন জানান, ছোটবেলা থেকেই তার বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরির শখ ছিল। কিন্তু নদীভাঙন ও পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে তা পূরণ হয়নি। ২০১৮ সালে একটি এনজিওতে কাজ করার সময় তিনি দেখেন, নারীরা সয়াবিন মিশিয়ে পুষ্টিকর খাবার তৈরি করছেন। সেখান থেকেই উৎসাহ পান। এরপর নিজেই বিভিন্ন মেলা ও অনুষ্ঠানে পণ্য বিক্রি করতে থাকেন। ২০২৪ সালে ঢাকায় পাঁচ দিনের একটি প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে ফুড প্রসেসিং, সংরক্ষণ এবং বিপণন বিষয়ে ধারণা পান এবং একটি চেইন ফুডশপের সঙ্গে যোগাযোগ হয়, যারা তার পণ্য নেয়ার আগ্রহ দেখায়। এরপর ২৫ জন নারীকে সঙ্গে নিয়ে শুরু করেন খাদ্য উৎপাদন। নারীরা প্রতিদিন খাবার তৈরি করে নিরাপদভাবে প্যাকেট করে। পরদিন সকালে যাত্রীবাহী বাসে খাবার পাঠানো হয় ঢাকায়। ফুডশপের লোকেরা বাস কাউন্টার থেকে পণ্য বুঝে নেন। এভাবেই গড়ে ওঠে শারমিনের সয়াফুড ব্র্যান্ড।
এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে অন্তত ৩০০ নারী সয়াফুড তৈরির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাদের অনেকেই স্থানীয়ভাবে সয়াবিনভিত্তিক খাবার তৈরি করছেন। শারমিন মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা আয় করেন। অন্য নারীরাও মাসে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে উপার্জন করছেন।
হাসান মাহমুদ শাকিল/এআরবি