মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষিকা রঞ্জিতা রানী, আজ তার কাছে নেই ওষুধ কেনার টাকা
ঝালকাঠির সরকারি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষিকা রঞ্জিতা রানী পাল (৭৫)। শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘ ৩৫ বছর। এ সময়ে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন। তার হাত ধরে গড়ে ওঠা হাজারো শিক্ষার্থী আজ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন। অথচ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে দারিদ্র্যের কষাঘাতে তিনি আজ অসহায়। উচ্চ রক্তচাপ আর ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগে ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারেন না। হাতে নেই ওষুধ কেনার টাকা।
ঝালকাঠি সদর উপজেলার দারখি গ্রামের যোগেন্দ্রনাথ বসুর কন্যা রঞ্জিতা রানী পাল। শৈশব থেকেই পড়াশোনার প্রতি তার অদম্য আগ্রহ ছিল। চামটা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, পরে ঝালকাঠি সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ১৯৭২ সালে তিনি শিক্ষকতা পেশায় আসেন। সেই বছরই যোগ দেন ঝালকাঠি শহরের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।
বিজ্ঞাপন
তখন স্কুলে প্রায় ৩০০ ছাত্রী আর ১৬ জন শিক্ষক ছিলেন। সহকর্মী হিসেবে তার সঙ্গে ছিলেন বিভা রানী, নুরজাহান বেগমসহ অনেকেই। সেই স্মৃতি বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।
প্রায় ৩৫ বছর শিক্ষকতা শেষে ২০০৭ সালে অবসরে যান রঞ্জিতা রানী পাল। আর্থিক ও পারিবারিক নানা কারণে পুরো পেনশন বিক্রি করে দেওয়ায় অবসরের সময় তিনি মাত্র ৭ লাখ টাকা হাতে পান। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই টাকাও চিকিৎসা, সংসারের খরচ ও নানা প্রয়োজন মিটিয়ে শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই। বর্তমানে শহরের আমতলা রোডে ছোট্ট, জরাজীর্ণ একটি বাড়িতে ছেলে তাপস পাল ও পুত্রবধূর সঙ্গে বসবাস করছেন তিনি। স্বামী বিমল কৃষ্ণ পাল মারা গেছেন গত বছর। এক মেয়ে সম্পা রানী দাস বরিশালে সংসার করছেন।
বিজ্ঞাপন
এখন বয়স ও অসুস্থতার কারণে তিনি একা হাঁটতেও পারেন না। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের জন্য নিয়মিত ওষুধ দরকার, কিন্তু কেনার সামর্থ্য নেই।
শিক্ষাকতার সময় তিনি ছিলেন ছাত্রীদের প্রিয়তম শিক্ষকদের একজন। কঠিন পাঠও তিনি সহজ করে বোঝাতেন। শুধু পড়াশোনা নয়, চরিত্র গঠনের শিক্ষাও দিতেন তিনি। অনেক সময় অভিভাবকদের সঙ্গে বৈঠক করে মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী করে তুলতেন।
রঞ্জিতা রানী পালের গড়া ছাত্রীরা আজ দেশের বিভিন্ন জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের মধ্যে কেউ প্রশাসনে, কেউ চিকিৎসক, কেউ আবার ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন, আমার ছাত্রী তাপতুন্নাহার এখন ঢাকা উত্তরের ডিসি। কামরুন্নাহার ও বৈশাখী বড়াল স্বনামধন্য চিকিৎসক। আরও কত কত ছাত্রী রয়েছে সারাদেশে।
আরও পড়ুন
কিন্তু তারপরই তার চোখ ভিজে ওঠে। বলেন, দেশের জন্য, সমাজের জন্য আমি যাদের মানুষ করেছি, আজ আমার খোঁজ নেওয়ার সময় কারও নেই।
অসুস্থতার কারণে তিনি আর আগের মতো চলাফেরা করতে পারেন না। মাঝেমধ্যে প্রতিমাসে একাধিকবার চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়, কিন্তু টাকার অভাবে অনেক সময় ডাক্তারও দেখানো হয় না।
তার ছেলে তাপস পাল সামান্য বেতনের একটি বেসরকারি চাকরি করেন। এই অল্প আয়ে সংসার চলে তাদের। ফলে রঞ্জিতা রানী পালকে প্রায়ই চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধের অভাবে ভুগতে হচ্ছে।
রঞ্জিতা রানী পালের সাবেক ছাত্রী চিকিৎসক বৈশাখী বড়াল বলেন, আমাদের স্কুলজীবনে রঞ্জিতা ম্যাডাম ছিলেন অনুপ্রেরণার নাম। তিনি শুধু পড়াশোনা নয়, আমাদের মানুষ হতে শিখিয়েছেন। আমি আজ চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছি, কিন্তু এর পেছনে তার বিশাল অবদান আছে। দুঃখের বিষয়, এত বড় একজন মানুষ আজ অসহায়ভাবে দিন কাটাচ্ছেন। আমি চাই, সমাজ ও রাষ্ট্র তার প্রতি দায়িত্ব নিক। আমরা তার ছাত্রীরা যদি এগিয়ে না আসি, তবে বিষয়টা লজ্জার হবে।
ওই স্কুলের প্রাক্তন এক ছাত্রী বদরুন্নেছা, যিনি বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি বলেন, রঞ্জিতা ম্যাডাম ছিলেন আদর্শের এক মূর্ত প্রতীক। তিনি ক্লাসে বলতেন- শিক্ষা শুধু পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য নয়, এটা তোমাদের চরিত্র গঠনের জন্য। আজ আমি ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে যে সততা নিয়ে কাজ করি, তার বীজ বপনে অনেক অবদান রয়েছে ম্যাডামের। কিন্তু তিনি আজ অসহায় জীবনযাপন করছেন। এটা আমাদের সমাজের জন্য বড় ব্যর্থতা।
সরকারি হরচন্দ্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্তমান সহকারী শিক্ষক মো. তারিকুল ইসলাম তারিক বলেন, আমি স্কুলে যোগদানের পরে ম্যাডামের কথা শুনেছি। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এক শিক্ষক। ছাত্রীদের পড়াশোনার উন্নতির জন্য তিনি দায়িত্বের বাইরেও কাজ করেছেন। আজ তিনি যখন এভাবে অসহায়, তখন আমাদেরই দায়িত্ব তাকে সাহায্য করা। আমরা শিক্ষক সমাজ চাইলে নিশ্চয়ই কিছু করতে পারব।
ওই বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক তৌহিদ হোসেন খান বলেন, রঞ্জিতা রানী পাল এক সময় আমার সহকর্মী ছিলেন। তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের অন্যতম একজন সেরা শিক্ষকদের একজন। তার মতো আমিও এখন অবসরে আছি। বর্তমান সময়ে তার মত সৎ নিষ্ঠাবান শিক্ষকের বড়ই অভাব। তিনি কখনও শিক্ষার্থীদের ভয় দেখাতেন না, বরং সাহস দিতেন। শিক্ষক হতে হলে আগে মানুষ হতে হয়, তিনি সেটাই। আজ তাকে এমন অবস্থায় দেখে আমি ব্যথিত। সমাজের বিত্তবান, তার সাবেক ছাত্রী ও সহকর্মীদের সামর্থ্য অনুযায়ী তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।
রঞ্জিতা রানী পালের মতো মানুষদের যেন আর এভাবে কাঁদতে না হয় এটা আমাদের সবার দায়িত্ব।
আরকে