পোস্ট অফিসের ভল্টে জাল টাকা, দুদিনের ব্যবধানে বিপাকে দুই গ্রাহক
শেরপুর সদর উপজেলার গণই মমিনাকান্দা গ্রামের নিরক্ষর নারী শাহিনা বেগমের সঞ্চয়ী হিসাব থেকে উত্তোলন করা টাকায় জাল নোট পাওয়া গেছে। শুধু তিনিই নন, একই পোস্ট অফিস থেকে টাকা তুলে ব্যাংকে জমা দিতে গিয়ে আরও একজন ব্যক্তি জাল নোটের ফাঁদে পড়েছেন। এ ঘটনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত ৭ অক্টোবর (মঙ্গলবার) দুপুরে শেরপুরের প্রধান ডাকঘর থেকে তিন বছর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা উত্তোলন করেন ৬০ বছর বয়সী শাহিনা বেগম। এরপর তিনি ওই টাকা বাড়িতে রেখে দেন। ১২ অক্টোবর (রোববার) সকালে তার মেয়ে সুমি আক্তার ঢাকা থেকে এসে মাকে নিয়ে শহরের উত্তরা ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গেলে ব্যাংক কর্মকর্তারা টাকাগুলো গুনে দেখতে পান, এর মধ্যে ৫৩টি এক হাজার টাকার নোট জাল।
বিজ্ঞাপন
এর আগে, গত বৃহস্পতিবার একই পোস্ট অফিস থেকে টাকা তুলে সোনালী ব্যাংকে জমা দিতে গেলে স্থানীয় রশিদা ফ্যাক্টরির ৩০ নম্বর কর্মচারী নুরু মিয়ার ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকার মধ্যে ২৫টি নোট জাল ধরা পড়ে। পরে পোস্ট অফিসের কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে সেগুলো বদলে দেন।
ভুক্তভোগী শাহিনা বেগম জানান, তিনি পোস্ট অফিসে তিন বছর মেয়াদি একটি সঞ্চয়ী আমানত হিসাব খুলেছিলেন। মেয়াদ শেষে টাকা তুলতে গিয়ে পোস্টাল অফিসার মানিক মিয়াকে বলেন, আমি লেখাপড়া জানি না, আমার সঙ্গে কোনো অভিভাবক নেই, আপনি আমার টাকা গুনে দিন। আমি টাকা রেখে দেব, যাতে কেউ জানতে না পারে। জানলে বিপদ হতে পারে। এরপর অফিসার তার হাতে টাকা দেন, যা তিনি বাড়িতে রেখে দেন।
বিজ্ঞাপন
পরে মেয়েকে নিয়ে ব্যাংকে গেলে দেখা যায়, টাকাগুলোর মধ্যে ৫৩টি জাল। শাহিনার মেয়ে সুমি আক্তার বলেন, অনেক কষ্টে আম্মা এই টাকা জমিয়েছেন। তিনি সোজাসাপ্টা মানুষ। পোস্টাল অফিসারকে লেখাপড়া না জানার কথা বলেছিলেন। তিনি সেই সুযোগ নিয়ে আম্মাকে জাল টাকা ধরিয়ে দিয়েছেন। পোস্ট অফিসের সিসি ক্যামেরা দেখে তদন্ত করলে সব পরিষ্কার হবে।
অন্য ভুক্তভোগী নুরু মিয়া বলেন, আমি প্রতি সপ্তাহে দুইবার ব্যাংকে টাকা জমা দিই। এরকম কোনো ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। এটা সম্পূর্ণ পোস্ট অফিসের দায়।
শেরপুর সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার ও ক্যাশ ইনচার্জ আব্দুর রহমান বলেন, রশিদা ফ্যাক্টরির কর্মচারী নুরু মিয়া ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকা জমা দিতে আসেন, যার মধ্যে পোস্ট অফিস থেকে তোলা টাকা ছিল। সেখানে ২৫টি এক হাজার টাকার নোট জাল ধরা পড়ে। পোস্ট অফিসের লোকজন সঙ্গে থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে জানানো হলে তারা নোটগুলো বদলে নেন।
উত্তরা ব্যাংকের ক্যাশিয়ার মাহবুব রহমান বলেন, টাকা গোনার সময় ৫৩টি এক হাজার টাকার নোট জাল পাওয়া যায়। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
শেরপুর পোস্ট অফিসের ট্রেজারার হাফিজুর রহমান বলেন, আমি অনেক দিন ধরে এখানে চাকরি করছি, এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। ৭ অক্টোবর প্রায় ৭ লাখ টাকা জমা হয়েছিল। এর মধ্যে ২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা শাহিনা বেগমকে দেন পোস্টাল অফিসার মানিক মিয়া। দিন শেষে তিনি আমাকে ক্যাশ বুঝিয়ে দেন। বিকাল হয়ে যাওয়ায় আমি ৪ লাখ টাকা মেশিনে গুনে রেখেছিলাম। একটু তাড়াহুড়ার কারণে সময় কম পাওয়া গিয়েছিল। মনে হচ্ছে, এখানেই কোনো ভুল হয়েছে। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি।
অভিযুক্ত পোস্টাল অফিসার মানিক মিয়া বলেন, ওই নারী ৭ অক্টোবর টাকা উত্তোলন করেন। পাঁচ দিন পর এসে বলছেন, টাকা জাল। এটা ঠিক নয়। আমরা গ্রাহকদের টাকা দেখে নিতে বলি, তিনিও টাকা বুঝে নিয়েছেন। এর দায় আমরা নিতে পারি না।
শেরপুর প্রধান ডাকঘরের পোস্টমাস্টার নূর কুতুব আলী বলেন, জাল টাকার ঘটনাটি শুনেছি। অভিযুক্তের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। কীভাবে ঘটনাটি ঘটল, তা জানার চেষ্টা চলছে। তদন্তে প্রমাণ মিললে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
শেরপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ হাসান বাদল বলেন, একজন নিরক্ষর নারী পোস্ট অফিস থেকে উত্তোলন করা ২ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ব্যাংকে জমা দিতে গিয়ে ৫৩টি নোট জাল ধরা পড়ে। একইভাবে, গত বৃহস্পতিবার পোস্ট অফিস থেকে নেওয়া ২ লাখ ৪৩ হাজার টাকার মধ্যে ২৫টি জাল পাওয়া যায়। এমনকি একজন পরিচিত ব্যক্তি নিউমার্কেটের একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ১০ হাজার টাকা তুলতে গিয়ে এক হাজার টাকার একটি নোট জাল পান। এসব ঘটনায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সচেতন নাগরিকরা বলছেন, এতে সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
শেরপুর সোনালী ব্যাংক পিএলসির শাখা ব্যবস্থাপক আব্দুল আউয়াল বলেন, জাল টাকার বিষয়টি আমি জানি। ৯ অক্টোবর আমাদের ব্যাংকে পোস্ট অফিস থেকে আনা টাকায় জাল নোট ধরা পড়ে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই নোটগুলো পাঞ্চ করে ধ্বংস করি। সব শাখাকে সতর্ক করা হয়েছে। পোস্ট অফিসের কাছে আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে, তবে এখনো কোনো জবাব আসেনি।
শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাল নোটের বিষয়টি ফেসবুক ও সংবাদে দেখেছি। পোস্ট অফিসের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। তারা অভিজ্ঞ এবং তাদের কাছে মেশিনও আছে তবুও কীভাবে জাল নোট গেল, তা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের সবাইকে জাল নোট নিয়ে সচেতন থাকতে হবে।
পোস্ট অফিসের লেনদেনকৃত টাকায় জাল নোট মিশে যাওয়ায় আতঙ্কে সাধারণ গ্রাহকরা বলছেন, এই ঘটনায় পোস্ট অফিসের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
নাইমুর রহমান তালুকদার/এআরবি