শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর জাতির সেই মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল করতে প্রয়োজন একজন আদর্শ শিক্ষক। এমনি একজন শিক্ষক ছিলেন মো. এমদাদুল হক খোকন ওরফে বড় স্যার, যিনি ১৯৭২ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত মেহেরপুরের গাংনী মডেল পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন।

এমদাদুল হক খোকন ওরফে হক বড় স্যারের ৪০ বছরের শিক্ষাদানে মিলেমিশে আছে কঠোরতা ও মমতা। ক্লাসরুমে তার ভয়ে শিক্ষার্থীরা থর থর করে কাঁপতেন, তবে একইসঙ্গে তিনি ছিলেন যত্নশীল। শিক্ষার্থীদের শেখার আগ্রহকে উজ্জীবিত করতেন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ সুগম করতেন। এই মিলিত শিক্ষাদানের ধারা শিক্ষার্থীদের জীবনে অমর প্রভাব ফেলেছে।

তার শিষ্যরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভা প্রমাণ করেছেন। অনেকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ এবং সরকারি উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করছেন। শুধু তাই নয়, তার শিক্ষার ছোঁয়ায় শিক্ষার্থীরা কেবল শিক্ষাগত জ্ঞান নয়, মানবিক গুণাবলী ও নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও অর্জন করেছেন।

স্যারের প্রাক্তন ছাত্র মেহেরপুর ২ আসনের সাবেক এমপি আমজাদ হোসেন বলেন, বড় স্যারের নাম শুনলেই আমরা ভয় পেতাম। তিনি আমাদের যেমন শাসন করতেন তেমনি আমাদেরকে ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষাদান করতেন।  তিনি আমাদের ইংরেজি পড়াতেন। শুধু পড়াশোনায় নয়, তার কাছ থেকে আমরা চরিত্র, নৈতিকতা, শৃঙ্খলাবোধ, নেতৃত্ব দেওয়ার গুনাবলি অর্জন করেছি।

গাংনী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার ডা. ফারুক হোসেন বলেন, স্যারের ক্লাসে প্রবেশ করলে আমাদের হৃদয় ধমধম করত। তিনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন, কিন্তু তার কঠোরতার মধ্যে ছিল শিক্ষার গভীর অনুভূতি। তার শেখানো নৈতিকতা ও অধ্যবসায় আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক। আজ যে পেশায় আছি, তার পেছনে স্যারের অবদান অনস্বীকার্য।

গাংনী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মুস্তাফিজুর রহমান বাবলু বলেন, স্যার আমাদের জীবনে শুধুই শিক্ষক ছিলেন না, বরং একজন পথপ্রদর্শক। তিনি কেবল জ্ঞান দিয়েই না, বরং জীবনের মূলমন্ত্রও শেখাতেন। তার শিক্ষার ছোঁয়ায় আজ অনেক শিক্ষার্থী সমাজে অনন্য সাফল্য অর্জন করেছে। স্যারের শিক্ষার প্রতি আনুগত্য ও নিষ্ঠা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

এমদাদুল খোকন ওরফে বড় স্যারের শিক্ষাদানের ধরন ছিল বিশেষ। তিনি ক্লাসে শুধুই বইয়ের পাঠ না করে শিক্ষার্থীদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে যুক্ত করতেন। তার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কেবল শিক্ষাগত জ্ঞানই অর্জন করেননি, বরং আত্মনির্ভরশীলতা, দায়িত্ববোধ এবং নেতৃত্বের গুণও অর্জন করেছেন।

বিদ্যালয় জীবনকালে স্যার নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ওপর নজর রাখতেন। তিনি শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা শনাক্ত করে তা সমাধানের জন্য পৃথক প্রচেষ্টা করতেন। এই যত্নশীলতা শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস ও উদ্যম বৃদ্ধি করেছিল।

স্যারের দায়িত্ব পালনের সময় গাংনী মডেল পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছিল। শিক্ষার মান বৃদ্ধি, পরীক্ষার ফলাফলে উৎকর্ষতা এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিক বিকাশ—এই তিনটি ক্ষেত্রে তার অবদান যুগান্তকারী।

এমদাদুল হক খোকন ওরফে হক বড় স্যার বলেন, আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া হলো, সবাই আমাকে ‘বড় স্যার’ নামে চেনে। শিক্ষকতা জীবনে আমি কঠোর শিক্ষক ছিলাম, কিন্তু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতাম। শাসনের প্রয়োজন হলে কঠোরভাবে শাসন করেছি, বিনোদনের সময় আনন্দ ভাগাভাগি করেছি। বর্তমানে শিক্ষার পরিবেশ পরিবর্তিত হয়েছে। রাজনৈতিক চাপ এবং নানামুখী সরকারি নির্দেশনার কারণে শিক্ষার্থীদের কঠোরভাবে শাসন করা কঠিন হয়ে গেছে। এ কারণে শিক্ষার প্রকৃত যৌবন হারাচ্ছে।

আজও স্যারের প্রেরণায় গাংনীসহ দেশের নানা প্রান্তে তার শিষ্যরা সমাজে দায়িত্ব পালন করছেন। বড় স্যারের জীবন ও শিক্ষাদানের ধারা প্রমাণ করে, একজন শিক্ষক কেবল জ্ঞান শিখানই না, তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চরিত্র, নৈতিকতা ও নেতৃত্ব গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শিক্ষা ও নৈতিকতার আলোয় আলোকিত এই মহান শিক্ষকের জীবন শিক্ষার্থীদের জন্য চিরন্তন প্রেরণা হয়ে থাকবে।

এএমকে