শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে পড়াশোনার তদারকি করতেন শিক্ষক মহিউদ্দিন
শিক্ষকদের বলা হয় জাতি গঠনের কারিগর, পথপ্রদর্শক। একজন আদর্শ শিক্ষকই পারেন শিক্ষার্থীদের নৈতিক শিক্ষা দিয়ে সমাজের যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। সমাজে যেসব শিক্ষক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন তাদেরই একজন ভোলার মো. মহিউদ্দিন। যিনি প্রায় দীর্ঘ ৩৭ বছর শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন ভোলার কয়েক হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে, গড়েছেন অনন্য দৃষ্টান্ত। তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন।
১৯৬২ সালের ১ মার্চ ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের বাঘাবাড়ির সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মো. মিয়া হাওলাদার ও আমিনা বেগম দম্পতির ঘর আলোকিত করে জন্ম নেন শিক্ষক মো. মহিউদ্দিন।
বিজ্ঞাপন
কাচিয়া বাঘাবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে এসএসসি পাশ করেন কবি মোজাম্মেল হক খড়কি ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে। এইচএসসি ও বিএসসি পাস করেন ভোলা সরকারি কলেজে থেকে এবং বরিশাল বিএম কলেজ থেকে এমবিএ পাশ করেন।
১৯৮৫ সালে সদর উপজেলার টবগী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মধ্য দিয়ে মো. মহিউদ্দিনের শিক্ষকতা জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে পদোন্নতি পেয়ে ১৯৯৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আলীনগর স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ২৮ মার্চ ভোলা টাউন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা পেশার ইতি টানেন।
বিজ্ঞাপন
ব্যক্তি জীবনে শিক্ষক মহিউদ্দিনের স্ত্রী শামিম ইয়াসমিন, ছেলে ইঞ্জিনিয়ার সাইদ উদ্দিন শোভন ও মেয়ে ইসরাত জাহান জেনি রয়েছেন। বর্তমানে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে সদর উপজেলা সড়ক-সংলগ্ন ধনিয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কানাইনগর গ্রামে নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন।
শিক্ষক মহিউদ্দিন বর্তমানে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ভোলা জেলার সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র সিটিজেন সংজ্ঞের অর্থবিষয়ক সম্পাদক, জেলা স্কাউটের সহকারী কমিশনার ট্রেনিং, মুসলিম এডুকেশন কমিটির অর্থ সম্পাদক, দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির (দুপ্রক) সদস্য, ভোলা ডায়াবেটিস হাসপাতাল সমিতি ও আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের আজীবন সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। এ ছাড়া, মকবুল সাইদা অ্যাকাডেমি, মকবুল সাইদা হিফজুল কুরআন মাদরাসাও এতিমখানার পরিচালক হিসেবে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। সেখানে প্রায় ২০০ শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেন।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে মো. মহিউদ্দিন বিদ্যালয়ে অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। প্রধান্য দিয়েছেন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি, শৃঙ্খলা, পাঠদান, খেলাধুলা ও ডিজিটাল পাঠদান। এ ছাড়া, বিদ্যালয়ের বাইরে বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা নিজ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াশোনা তদারকি করেন।
আরও পড়ুন
জানতে চাইলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় আমার অবসরের সময়গুলো খুবই সুন্দরভাবে যাচ্ছে। আমি যেখানেই যাই বা যে প্রতিষ্ঠানেই যাই সেখানেই আমার ছাত্র-ছাত্রীদের দেখতে পাই। এমনও হয়েছে মন্ত্রণালয়ে চাকরিরত আমার ছাত্র, আমি তাকে চিনতে পারিনি, সে আমাকে ঠিকই চিনেছে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষকতা মহান পেশা, এটাকে বানিজ্যিকভাবে নেওয়া হলে শিক্ষকতা থাকে না। আজকাল দেখা যায়, শিক্ষকদের কেউ কেউ টাকার পেছনে ঘোরেন। আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াশোনার পাশাপাশি ভালো মানুষ করার চেষ্টা করেছি। অন্যান্য শিক্ষকদের নিয়ে বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময়ের বাইরেও কাজ করেছি। বোর্ড পরীক্ষা চলাকালীন রাতে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে গিয়ে তাদের পড়াশোনার তদারকি করেছি।
শিক্ষকদের প্রতি আমার অনুরোধ—টাকার পেছনে বেশি না ঘুরে সামাজিকভাবে দেশটাকে উন্নত করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের পেছনে সময় দিলে তাহলেই তারা মানুষ হবে, দেশ উন্নত হবে।
শিক্ষক মো. মহিউদ্দিনের ছাত্র সহকারী ইংরেজি শিক্ষক মো. ইব্রাহিম, চাকরিজীবী মো. ইউসুফ, মো. মাকসুদুর রহমান ও মো. হাচনাইন আবেগাপ্লুত হয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্যার আমাদের জীবনের পথপ্রদর্শক ও অনুপ্রেরণা। আমরা যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলাম তখন সবকিছু এতটা উন্নত ছিল না। কুপি ও হারিকেনের আলোতে পড়াশোনা করেছি। মনে আছে, পরীক্ষার আগেরদিন রাতে মহিউদ্দিন স্যার কয়েকজন স্যারকে সঙ্গে নিয়ে রাতে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়েছেন, আমরা পড়াশোনা করি কিনা তদারকি করার জন্য। ক্লাসেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট ভালো শিক্ষক। শ্রেণিকক্ষে আমাদের পাঠদান থেকে শুরু করে তা তদারকি, সবখানেই স্যার ছিলেন সক্রিয়।
ভোলা জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আজাহারুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিক্ষক তার চাকরি জীবনে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। শিক্ষার্থীদের সৎ পরামর্শ দিতে গিয়ে সেটি তাদের রক্ত মাংসে মিশে যায়। মো. মহিউদ্দিনের মতো শিক্ষকরা যদি সমাজের যে কোনো কাজে অবদান রাখেন তাহলে সমাজ উপকৃত হবে। পাশাপাশি যদি আমাদের নতুন প্রজন্ম শিক্ষকদের থেকে সততা ও আদর্শ যথাযথভাবে ধারণ করে তাহলে সমাজের সব অন্যায়-অপরাধ-দুর্নীতি দূর হয়ে যাবে বলেও মনে করেন তিনি।
মো. খাইরুল ইসলাম/এএমকে