চিলমারী বিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা প্রথম উত্তোলন করেন শিক্ষক জয়নুল
কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী উপজেলার শিক্ষাঙ্গনে এক আলোকবর্তিকা শিক্ষক জয়নুল আবেদীন। চিলমারী উচ্চ বিদ্যালয়ের এই প্রধান শিক্ষককে এখনো ভুলতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। তার স্নেহ, কঠোর শৃঙ্খলা আর দিকনির্দেশনায় গড়ে ওঠা প্রজন্ম আজ দেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবদান রেখে চলেছেন।
১৯৩৬ সালের ১ মে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রমনা মডেল ইউনিয়নে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মো. জয়নুল আবেদীন। তিনি ওই এলাকার নজির উদ্দীন ব্যাপারীর ছেলে ছিলেন।
বিজ্ঞাপন
জয়নুল আবেদীন অল্প বয়স থেকেই ছিলেন তুখোর মেধাবী। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শেষে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে বি.এ. ও বি.এড. ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা যে কেবল চাকরি নয়, বরং এক মহৎ ব্রত এ জীবনদর্শন তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন। ১৯৬২ সালের ১৭ জুলাই চিলমারী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। টানা ৩৯ বছর দায়িত্ব পালন শেষে ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল অবসর গ্রহণ করেন। দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে একই বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে অবস্থান, যা এক বিরল দৃষ্টান্ত।
বিজ্ঞাপন
পরিশ্রমী এই শিক্ষকের সময়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান দ্রুত বেড়ে ওঠে। শৃঙ্খলা ও সততার মিশেলে তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তার ছাত্ররা আজ দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত। কারো কারো কাঁধে বিচারকের দায়িত্ব, কেউ প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট, আবার কেউ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হয়ে আলো ছড়াচ্ছেন। কেউ কেউ রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন বিদেশের মাটিতে রাষ্ট্রদূত হয়ে। এ ছাড়া, অসংখ্য ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও পেশাজীবী তার হাতে গড়া শিক্ষার বীজ বপন করে আজ প্রতিষ্ঠিত। এই সফলতার পেছনে তার নিরলস শ্রম ও অনুপ্রেরণাই ছিল প্রধান শক্তি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্থানীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১১ মার্চ চিলমারী উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে প্রথমবারের মতো ‘স্বাধীন বাংলার পতাকা’ উত্তোলন করেছিলেন তিনি। তার এই সাহসী উদ্যোগ মুক্তিকামী মানুষের মনে স্বাধীনতার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
তার অসামান্য অবদাদের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯২ সালে চিলমারী উপজেলার ও ২০০০ সালে কুড়িগ্রাম জেলার শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৯৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত কুড়িগ্রাম জেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল মৃত্যু বরন করেন এই গুণী শিক্ষক।
আরও পড়ুন
শিক্ষার্থীদের মধ্যে জয়নুল আবেদীনের প্রতি ভালোবাসা আজও অবিচল। তারা মনে করেন, তার কারণে আজ তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছেন।
প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) আশরাফ-উদ-দৌলা তাজ বলেন, জয়নুল আবেদীন স্যার শুধু একজন শিক্ষকই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন পথপ্রদর্শক। তার পরিশ্রম ও নৈতিকতার পাঠ আজও আমার জীবনযুদ্ধে সাহস জোগায়। ১৯৬২ সালে যোগদান করার পর আমরা স্কুলের প্রথম ব্যাচ ছিলাম। আমাদেরকে ইংরেজি পড়াতেন। বাইরে কঠোর থাকলেও ভেতরটা ছিল নরম। স্কুল থেকে বিদায় নেওয়ার পর তার সঙ্গে ছিলে পারিবারিক সম্পর্ক।
প্রাক্তন ছাত্র মেমোরি হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. ফারুকুল ইসলাম ফারুক বলেন, স্যারের কঠোর শাসন অনেক সময় কষ্টদায়ক লাগলেও আজ বুঝতে পারছি সেই শাসন ছাড়া আমাদের জীবনে এগোনো সম্ভব ছিল না।
জয়নুল আবেদীনের বড় ছেলে সাজেদুল করিম সাজু বলেন, এখনো ভুলিনি বাবার হাতে হাত রেখে প্রথম স্কুলে প্রবেশের স্মৃতি। পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদগাহে যাওয়ার দিনগুলোর কথা। ভুলেনি পা পিছলে পড়তে গিয়ে সেই হাতটি। যে হাতটি প্রথমেই সহায়ক হাত হিসেবে এগিয়ে আসত। শিক্ষকের ছেলে হিসেবে পেতাম স্কুলের সবার ভালোবাসা। আমার বাবার জন্য দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাকে জান্নাতবাসী করেন।
সমাজ ও রাষ্ট্রে যে আলোকিত প্রজন্ম গড়ে উঠেছে, তার পেছনে অন্যতম কারিগর ছিলেন এই মানুষটি। তিনি দেখিয়েছেন একজন শিক্ষকের প্রভাব কেবল একটি প্রজন্ম নয়, বরং পুরো সমাজকে বদলে দিতে পারে। তাই চিলমারীর মানুষ আজও শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করে শিক্ষক জয়নুল আবেদীন শুধু একজন শিক্ষক নন, তিনি শিক্ষার্থীদের জীবনে এক অনন্ত প্রেরণার নাম।
মমিনুল ইসলাম বাবু/এএমকে