‘একসময় শ্রেণিকক্ষে শত শত শিক্ষার্থীকে পাঠ দিতাম, আজ আমি নিজেই জীবনের পাঠ নিচ্ছি, কষ্টের পাঠ।’ কথাগুলো বলছিলেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক গোলাম রহমান। চুয়াডাঙ্গা শহরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে টানা ৩৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন তিনি। ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি অবসরে যাওয়ার পর থেকে কেটে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়। এখন তার দিন কাটছে একেবারেই মানবেতর অবস্থায়।

স্ত্রী ফাতেমাকে নিয়ে তিনি বসবাস করেন চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বুজরুক গড়গড়ি মাদরাসাপাড়ায় নিজ বাড়িতে। দুই ছেলে ও এক মেয়ে থাকলেও তাদের কাছ থেকে বিশেষ কোনো সহযোগিতা পান না এই প্রবীণ শিক্ষক। বড় ছেলে ঠিকাদারি করেন, ছোট ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢাকায় থাকেন। মেয়েও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বিবাহিত জীবনে শ্বশুরবাড়িতে। সন্তানরা নিজেদের সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বাবার জীবনের কঠিন বাস্তবতা তারা সামলাতে পারছেন না।

গোলাম রহমানের পুরো যৌবন কেটেছে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে। শিক্ষকতা জীবন শুরু হয় ১৯৭৬ সালে আলমডাঙ্গার নাগদাহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিত শিক্ষক হিসেবে। তখন তার বেতন ছিল মাত্র ২১০ টাকা। এক বছর পর তিনি ডিঙ্গেদহ সোহরাওয়ার্দ্দী স্মরণী বিদ্যাপীঠে জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হন। এরপর ১৯৭৮ সালের ১৪ মার্চ থেকে চুয়াডাঙ্গা শহরের আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৩৫ বছরের শিক্ষকতা। শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা, সততা আর নিষ্ঠায় দায়িত্ব পালন—সবকিছুই তার জীবনকে শিক্ষার আলোয় ভরিয়ে তুলেছিল। পাশাপাশি যশোর শিক্ষা বোর্ডের প্রধান পরীক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

শিক্ষক গোলাম রহমান এখন মাত্র একটি হোম টিউশনি করেন। মাস শেষে হাতে আসে মাত্র ২ হাজার টাকা। এই টাকাই তার সংসারের একমাত্র ভরসা। অথচ চিকিৎসা, ওষুধ আর সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে এ অর্থ কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, সব মিলিয়ে টানা ৩৭ বছর শিক্ষকতা করেছি। এখন বয়স হয়েছে, শরীরেও নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। আমার স্ত্রীও অসুস্থ। সংসারের খরচ জোগাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়। আগে কয়েকটা টিউশনি করতাম, এখন শক্তি ফুরিয়ে এসেছে, তাই শুধু একটা টিউশনি করি। ২ হাজার টাকা পাই টিউশনি থেকে। ছেলেকে সামান্য কিছু দিই। এ দিয়ে আজকাল কি হয়? সত্যি বলতে, কষ্টের কথা কাউকে বোঝানোই দায়।

শিক্ষক গোলাম রহমান বলেন, শিক্ষার্থীরা আমাকে এখনো মনে রাখে, রাস্তায় দেখা হলে এগিয়ে এসে সালাম দেয়। এটুকুই আমার বড় পাওয়া।

এমন দৃশ্যই বেদনাহত করে তার সহকর্মীদেরও। চুয়াডাঙ্গা সদরের তিতুদহ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ফজলুর রহমান বলেন, আমরা সারাজীবন শিক্ষকতা করে দেশের সন্তানদের মানুষ করেছি। অথচ অবসরের পর অনেক শিক্ষক মানবেতর দিন কাটান। শিক্ষকরা সমাজের আলো, অথচ শেষ বয়সে তারা যেন অন্ধকারে হারিয়ে যান, এ দৃশ্য খুব কষ্টের।

শিক্ষক গোলাম রহমানের সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে কল রিসিভ না করায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের করা সম্ভব হয়নি।

চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সিগঞ্জ সৃজনী মডেল মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক আহাদ আলী মোল্লা বলেন, একজন জীববিজ্ঞানের শিক্ষক হয়েও আজ তিনি জীবনের কঠিন বাস্তবতার সামনে অসহায়। যাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছিলেন, সেই সমাজের কাছেই তিনি এখন যেন বিস্মৃত। একটি টিউশনির টাকায় সংসার চালানো তার জন্য যেমন অসম্ভব হয়ে পড়ছে, তেমনি বয়ে যাওয়া দিনগুলোও তার কাছে হয়ে উঠছে এক দীর্ঘ সংগ্রামের নাম।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সহকর্মী গোলাম রহমান স্যার যে পরিস্থিতির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, সেটা ভীষণ কষ্টের। জীবনের সেরা সময়টা তিনি শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিয়েছেন। অথচ আজ তিনি স্ত্রীকে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন, মাত্র একটি টিউশনি করে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন। একজন শিক্ষক যদি এমন দুরবস্থায় পড়েন, তবে তা পুরো সমাজের জন্য লজ্জার বিষয়। শিক্ষকতার মর্যাদা শুধু মুখে বললেই হবে না, অবসরে গিয়ে যেন কোনো শিক্ষককে এভাবে দুঃখ-কষ্টে না পড়তে হয়—তা নিশ্চিত করতে হবে।

চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বড় সলুয়া নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক আহসান হাবীব শিপলু বলেন, আমাদের শিক্ষক সমাজকে সম্মানের চোখে দেখা হতো কিন্তু এখন সম্মানটা নির্ভর করে সম্মানির ওপর।  আমাদের যে বেতন দেওয়া হয় তা দিয়ে সত্যিকার অর্থে মাস চলা দায়। আবার অবসর নেওয়ার পর হয় আরও কষ্টের কারণ। এককালীন ভাতা পেতে পেতে অনেকে মৃত্যু বরণ করেছেন।  তা ছাড়া, যখন সেটা হাতে পায় তা দিয়ে শেষ বয়সের চিকিৎসা খরচ বহন করতে হিমশিম খেতে হয়। তাই এর উপযুক্ত সমাধান সব শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা। কারণ একই শিক্ষাক্রমের, একই পাঠ পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে কেন আমরা আজ উপেক্ষিত।

এএমকে