মো. কুদ্দুস শেখ

১৮ বছর বয়সে মোটর শ্রমিকের কাজে যোগ দেন মো. কুদ্দুস শেখ (৫৮)। প্রথমে বাসের হেলপার হয়ে কাজ শুরু করলেও পরে ধরেন বাসের স্টিয়ারিং। দীর্ঘ ৩৫ বছর পরিবহন সেক্টরে কাজ করার পর চোখের সমস্যা ও ব্রেন স্ট্রোকজনিত কারণে ছাড়তে হয় চাকরি।

টানা ৩৫ বছর পরিবহন সেক্টরে থেকে বাসের চাকা ঘোরালেও ঘোরেনি তার নিজের ভাগ্যের চাকা। শেষ বয়সে এসে এখন তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন। স্ট্রোকজনিত কারণে এখন তিনি ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। দেখতে পারেন না চোখে।

মো. কুদ্দুস শেখ রাজবাড়ী পৌরসভার ৬নং ওয়ার্ডের সজ্জনকান্দা গ্রামের কাহারপাড়া এলাকার বাসিন্দা। স্ত্রী, তিন ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি নিয়ে ৮ সদস্যের পরিবার তার।

জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে ১৮ বছর বয়সে মোটর শ্রমিক লাইনে আসেন কুদ্দুস শেখ। প্রথমে বাসের হেলপারি করতেন। তখন ১৫-২০ টাকা হাজিরা পেতেন তিনি। ৮ বছর বাসের হেলপারি করার পর ১৯৯৪ সালে তিনি বাসের স্টিয়ারিং ধরেন। টানা ২৬ বছর বাসের ড্রাইভারি করেন। এ সময় রাজবাড়ীর একাধিক পরিবহন ও লোকাল বাস চালান তিনি। কিন্তু ২০২০ সালের দিকে চোখের রেটিনার সমস্যার কারণে স্ট্রোক করেন তিনি। তখন থেকেই গাড়ি চালানো বন্ধ হয়ে যায় কুদ্দুসের। তখন রাজবাড়ী, ফরিদপুর সহ ঢাকায় চিকিৎসা করান। এক চোখে সামান্য দেখলেও অন্য চোখ দিয়ে তিনি কিছুই দেখতে পারেন না। যে চোখে ঝাপসা দেখেন সেই চোখে আবার ছানি পড়েছে। চোখের সমস্যার মধ্যে আবার দেড় বছর আগে ব্রেন স্ট্রোক করেন তিনি। 

এখন পুরোপুরি বেকার অবস্থায় রয়েছেন কুদ্দুস। অসুস্থতার মধ্যে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে ২ হাজার টাকা পেলেও পরে তাকে আর কেউ সাহায্য সহযোগিতা করেনি। পরিবারে টানাপোড়েনের কারণে তিন ছেলেকেও লেখাপড়া করাতে পারেননি কুদ্দুস। সুদে ৪ লাখ টাকা নিয়ে বড় ছেলেকে দালালের মাধ্যমে পাঠান বাহারাইন। সেই ছেলের পাঠানো কিছু টাকা দিয়েই টানাটানির মধ্যে চলে তার সংসার। বাকি দুই ছেলে এখনো বেকার।

ড্রাইভার কুদ্দুস শেখ বলেন, চোখের সমস্যার কারণে চাকরি হারাই। ধারদেনা করে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ করি চোখের অপারেশন করি। চোখের সমস্যা কাটতে না কাটতেই ব্রেন স্ট্রোক হয় আমার।এরপর থেকেই ঠিকমতন কথা বলতে পারিনা, বেঁধে যায়। হাঁটতেও পারিনা।টাকার অভাবে আর ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি। যেই একটা চোখ ভালো রয়েছে সেটাতেও ছানি পড়েছে।অপারেশন করতে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা লাগবে। টাকার অভাবে অপারেশন করতে পারছি না আমি।

তিনি আরও বলেন, আমার এখন ৭ জনের সংসার। বড় ছেলের বিদেশ থেকে পাঠানো ১২ হাজার টাকায় এই বাজারে সংসার চালানো কষ্ট। আমি তো এখন বেকার। অসুস্থতার কারণে প্রত্যেক মাসে প্রায় চার হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। সবার কাছ থেকে চেয়েচিন্তে নিয়ে এই ওষুধের টাকা জোগাড় করি।

পরিবহন লাইনে থেকে ড্রাইভার বা স্টাফদের ভাগ্যের উন্নয়ন হয় কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ড্রাইভারি বা হেলপারি করে আমার দেখা মতে কারও ভাগ্যের উন্নয়ন হয়নি। যদি বাপ-দাদার কিছু না থাকে বা আত্মীয়-স্বজন সহযোগিতা না করে এই সেক্টরের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন হবে না। কারণ আমরা যা কামাই করি তাই দিয়ে খাই। আমি গুছাবো কোন সময় আর ব্যবসা বাণিজ্য বা ভাগ্যের উন্নয়ন করবো কোন সময়। আমার কোনো বাজে খরচ ছিল না। তারপরও আমি অস্বচ্ছল। শেষ বয়সে এসে আমার কষ্ট করতে হচ্ছে। মানুষের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। আমার শেষ বয়সে এসে আমার কোনো  চাওয়া পাওয়া নেই। চিকিৎসা আর খেয়ে পরে একটু বেঁচে থাকতে পারলেই হয়, বড় লোক হবার ইচ্ছে নেই। চলার মতো অবস্থা হলেই হয়।

রাজবাড়ী জেলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের তথ্য মতে, পরিবহন ও অভ্যন্তরীণ রুটের লোকাল বাসসহ জেলায় মালিক গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত বাসের সংখ্যা ১৭৬টি। জেলায় পরিবহন ও লোকাল বাসের চালক রয়েছে ৩০০ জন, হেলপার ৩০০ জন, সুপারভাইজার ২৫০ জন ও টিকিট বিক্রেতাসহ অন্যান্য স্টাফ রয়েছে ১৫০ জন। চালকের বেতন মান ভেদে প্রতিদিন হাজিরা ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা, হেলপারের হাজিরা সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং সুপারভাইজারের প্রতিদিন হাজিরা গাড়ি ভেদে সর্বনিম্ন ৭০০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত। প্রত্যেক বাসেই বদলি ড্রাইভার, হেলপার ও সুপারভাইজার রয়েছে। একজন ড্রাইভার মাসে গড়ে ২৫ দিন গাড়ি চালায়। এছাড়াও ড্রাইভার, হেলপার ও সুপারভাইজারদের বেতনের বাইরেও উপড়ি আয় রয়েছে।

রাজবাড়ীর অভ্যন্তরীণ রুটের বাসের চালক দুলাল মণ্ডল বলেন,পরিবহন সেক্টরে থেকে অনেক স্টাফই ভালো রয়েছে। তবে যারা নেশায় আসক্ত হয়ে যায় বা বাজে খরচ করে তারাই শেষ বয়সে এসে কষ্টে থাকে। আমি পরিবহন সেক্টরে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে রয়েছি। এক সময় হেলপার ছিলাম, এখন চালক হয়েছি। আল্লাহর রহমতে পরিবহন সেক্টরে থেকে পরিবার পরিজন নিয়ে ভালো রয়েছি আমি।

আরেক বাস চালক সোহেল মন্ডল বলেন, পরিবহন লাইনে মহাজন বা মালিকরা ভালো না হলে স্টাফরা ভালো থাকতে পারবে না। সড়ক দুর্ঘটনায় কোনো স্টাফ যদি পঙ্গুত্ববরণ করে তাহলে সে পরবর্তীতে আর এই লাইনে থাকতে পারে না। তখন তার সংসার চালাতে কষ্ট হয়। সেক্ষেত্রে মালিক বা মহাজন ভালো হলে আর্থিক সহায়তা করে থাকে। আর মালিকরা ভালো না হলে প্রথম অবস্থায় কিছু দিয়ে আর খোঁজ নেয় না।

মো. অলিউল্লাহ নামে বাসের এক হেলপার জানান, প্রায় ৮ বছর তিনি বাসের হেলপারি করছেন। যে টাকা বেতন পান এতে তার সংসার ও নিজের খরচ চালানো কষ্ট। তারপরও বাধ্য হয়ে হয়ে তিনি এই লাইনে আছেন। এই ৮ বছরে মোটর লাইনে থেকে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। করোনাকালে আয় রোজগার কমে যাওয়া। চলতি পথে পুলিশের হয়রানিসহ বিভিন্ন সময়ে যাত্রীদের কটুকথা, ঝাড়ি শুনতে হয়েছে তাকে। তারপর তিনি ধৈর্য ধরেন হাসিমুখে মেনে নিয়ে কাজ করেছেন।

রাজবাড়ী সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক সুকুমার ভৌমিক বলেন, বর্তমান বাজারে ড্রাইভার, হেলপার ও সুপারভাইজারদের যে বেতন দেওয়া হয় তাতে তাদের ভালো মতো সংসার চলে যায়। বেতনের বাইরেও তাদের উপড়ি আয় রয়েছে। কিন্তু যেসব ড্রাইভার বা হেলপার মাদকাসক্ত হয়ে যায় বা যারা বাজে খরচ করে, অন্যান্য আসক্তিতে পড়ে যায় তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। তারা মানবেতর জীবনযাপন করে। তারা তাদের ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব চালক,হেলপার বা সুপারভাইজার নিহত হয় তাদের বিআরটিএ ট্রাস্টি বোর্ড থেকে নিহতদের ৫ লাখ, পঙ্গুত্ববরণ কারীদের ৩ লাখ টাকা এবং আহতদের ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়। এছাড়াও সড়ক দুর্ঘটনায় চালক, হেলপার, সুপারভাইজার নিহত ও আহত হলে মালিকরাও তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করে থাকেন।

রাজবাড়ী সরকারি আদর্শ মহিলা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নাজমুস সাকিব বলেন, পরিবহন লাইনে শ্রমিকদের দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে হয়। একটানা কাজ করার ফলে তাদের মানসিক চাপ বাড়ে, যা তাদের ধৈর্য ও মেজাজ খিটখিটে করে তোলে। শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে।  এর ফলে তারা পরিবারের জন্য সময় দিতে পারে না এবং নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনেও একাকিত্ব অনুভব করে। উন্নত মজুরি বা জীবনযাত্রার অভাব, কাজের অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক অবহেলার কারণে তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। কাজের নিরাপত্তা না থাকা এবং দুর্ঘটনা বা অসুস্থতার ঝুঁকি তাদের মনে সবসময় এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করে।

তিনি আরও বলেন, এ  কারণে শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি, কর্মঘণ্টা এবং অন্যান্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত ও নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি করতে হব, যা তাদের দুর্ঘটনা ও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে।  শ্রমিকদের কাজের প্রতি সামাজিক সম্মান ও স্বীকৃতি বাড়াতে হবে, যাতে তারা নিজেদের মূল্যহীন মনে না করে।

আরএআর