ঐতিহ্যবাহী আনন্দবাজারে খাসজমি লিজ নিয়ে উত্তেজনা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ধর্মঘটে অচল প্রধান বাণিজ্য এলাকা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী আনন্দবাজারকে ঘিরে পুরোনো বাঁশবাজারের খাসজমি লিজ বিতর্কে শহরের প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে। ১ নম্বর খাস খতিয়ানের আওতাধীন প্রায় ২১ শতাংশ হাটবাজার শ্রেণির জমি সম্প্রতি ৩৩ জনের নামে বন্দোবস্ত (লিজ) দেওয়ার পর থেকেই পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
খাসজমির লিজ বাতিল, মামলা প্রত্যাহার ও বন্ধ দোকান খুলে দেওয়ার দাবিতে আনন্দবাজার, লাখিবাজার, টানবাজার, সড়কবাজার ও নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ঘোষণা করেছেন। শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ১১টার পর থেকেই দোকানপাটের শাটার বন্ধ হয়ে যায়, ফাঁকা হয়ে পড়ে রাস্তাঘাট পরিস্থিতি যেন অঘোষিত কারফিউ। এতে দিনের বেলায় শহরের প্রধান বাজার এলাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
বিজ্ঞাপন
শুধু তাই নয়, লিজ বাতিল, আটক ব্যবসায়ী নেতাদের মুক্তি ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে নারী ব্যবসায়ীরাও ঝাড়ু হাতে মিছিল করেছেন। শুক্রবার দুপুরে তারা বিক্ষোভে অংশ নেন।
ব্যবসায়ীদের দাবি, বাঁশবাজারের খাসজমি লিজে গেলে তাদের মালামাল ওঠানামার জায়গা থাকবে না, এতে তীব্র যানজট ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিবেচনা না করে এমন সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া অসম্ভব। এতে বড় ধরনের লোকসানে পড়তে হবে তাদের। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, এই বন্দোবস্তের সঙ্গে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা জড়িত।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
এদিকে ‘ব্যবসায়ী মহল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ ব্যানারে ধর্মঘটের কারণে শহরের পাঁচটি প্রধান বাণিজ্যিক এলাকা আনন্দবাজার, লাখিবাজার, সড়কবাজার, টানবাজার ও নিউ মার্কেট প্রায় অচল হয়ে গেছে। বাজার বন্ধ থাকায় সাধারণ ক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। বন্ধ গলিতে টাঙানো ধর্মঘটের ব্যানারে প্রতিবাদের প্রতীকী চিত্র দেখা গেছে।
নিয়মিত কেনাকাটা করতে আসা রোকসানা আক্তার বলেন, বাচ্চাদের জন্য বাজার করতে এসে দেখি সব দোকান বন্ধ। ধর্মঘট হবে জানতাম না। এখন বুঝতে পারছি না, বাড়ি গিয়ে কী রান্না করব।
তোহরা বেগম বলেন, সাড়ে ১১টার দিকেও দোকান খোলা ছিল। কিছুক্ষণ পর একদল লোক এসে দোকান বন্ধ করতে বললে সবাই ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেয়। অনেক জিনিস কেনা বাকি ছিল, কিছুই নিতে পারিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দোকানদার বলেন, আমরাও চাই প্রশাসন ন্যায্য সিদ্ধান্ত দিক, কিন্তু বাজার বন্ধ রাখলে ক্ষতি আমাদেরই।
জানা গেছে, বুধবার দুপুরে সীমানা নির্ধারণের সময় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে সরকারি কর্মচারীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। পরে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের যৌথ অভিযানে আনন্দবাজারের তোহা বাজার এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এতে প্রশাসন ও ভূমি কার্যালয়ের অন্তত ১৫ জন সদস্য আহত হন।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আনন্দবাজার সংলগ্ন পুরোনো বাঁশবাজারে ১ নম্বর খাস খতিয়ানের আওতাধীন প্রায় ২১ শতাংশ হাটবাজার শ্রেণির জমির মধ্যে ২০ দশমিক ৯৪ শতাংশ জায়গা ৩৩ জনের নামে বন্দোবস্ত দেওয়া হয়েছে। সেই বন্দোবস্তের প্রতিবাদে বুধবার ব্যবসায়ীরা আন্দোলনে গেলে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা হয়।
এ ঘটনার পর বিকেলে সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ ও প্রশাসনের যৌথ অভিযানে আনন্দবাজার-তেঁতুলতলা (তোহা বাজার) এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিফাত মো. ইশতিয়াক ভূঁইয়া বলেন, বাজারের বন্দোবস্ত সরকারি নীতিমালা মেনেই দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা যেহেতু উদ্বিগ্ন, জেলা প্রশাসক স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন। তবে ধর্মঘটের কারণে সাধারণ ক্রেতা-বিক্রেতারা ভোগান্তিতে পড়ছেন।
তিনি আরও বলেন, সীমানা নির্ধারণের সময় সরকারি কর্মচারীদের ওপর হামলা হয়েছে। যারা হামলা করেছে, তাদের ছাড় দেওয়া হবে না আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে ৩৩ জনকে জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্টে দাবি করা হচ্ছে, বন্দোবস্ত পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ সিরাজুল ইসলাম সিরাজের পরিবারের সদস্যদের নাম রয়েছে।
আরও পড়ুন
এক প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, ফেসবুকে নির্দিষ্ট এক রাজনৈতিক ব্যক্তির পরিবারকে ঘিরে গুজব ছড়ানো হয়েছে, যা সত্য নয়। বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। যা ঘটেনি, সেটিকে বিকৃতভাবে ছড়ানো দুঃখজনক।
বাজার ব্যবসায়ী সমিতির নেতারা জানান, আনন্দবাজার জেলা শহরের শত বছরের পুরোনো একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার। পুরোনো বাঁশবাজারের প্রায় ২১ শতাংশ খাস জায়গা কয়েক বছর আগে শহরের মেড্ডা এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। পরে যানজট নিরসনে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ওই জায়গাটি আনন্দবাজার ও আশপাশের বাজারের ব্যবসায়ীদের মালামাল লোড-আনলোডের কাজে ব্যবহার হচ্ছিল। এই জায়গা ছাড়া ব্যবসায়ীদের ট্রাক, কাভার ভ্যান বা পিকআপে মাল ওঠানো-নামানোর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই।
সম্প্রতি ওই ২০ দশমিক ৯৪ শতাংশ খাসজমি জেলা প্রশাসন ৩৩ জনের নামে বন্দোবস্ত দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা জনস্বার্থে দ্রুত বন্দোবস্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। অন্যথায় কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
মাজহারুল করিম অভি/এআরবি