রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুরিয়া ইউনিয়নে প্রত্যন্ত এক গ্রাম মাহেন্দ্রা। সেই গ্রামে ১৫০ গজের ছোট্ট একটি বাজার। বাজারটিকে দুইভাগ করেছে একটা সরু পাকা রাস্তা। রাস্তার দুই পাশে বিভিন্ন দোকানপাটের মধ্যে সব থেকে বেশি রয়েছে মোটরসাইকেলের শোরুম। এই মোটরসাইকেল বেচা-কেনাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ এই বাজারে চলে কোটি টাকার লেনদেন।

এটি মাহেন্দ্রা বাজার নামে পরিচিত। এখানে রয়েছে ৪৫টির মতো মোটরসাইকেলের শোরুম। যা থেকে মাসে ছয় থেকে আট কোটি টাকার লেনদেন হয়। সপ্তাহের ৭ দিনই পুরানো, নতুন সব ধরনের মোটরসাইকেল বেচা-কেনায় মুখর থাকে বাজারটি। 

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বেলপুকুরিয়া ইউনিয়নের মাহেন্দ্রা বাজারের দোকানগুলোতে বড় বড় সাইনবোর্ডে লেখা, এখানে নতুন-পুরোনো মোটরসাইকেল বেচা-কেনা চলে। সঙ্গে ফোন নম্বর ও একাধিক মোটরসাইকেলের ছবি। কারও শোরুম থাই গ্লাস দিয়ে ঘেরা। কোনোটিতে শুধুই শাটার লাগানো। বাজারের এসব শোরুমে প্রতিমাসে অন্তত ৫৫০ থেকে ৬০০টি মোটরসাইকেল বেচাকেনা হয়। রাজশাহী ছাড়াও দূর-দূরান্তের মানুষ শোরুমগুলোতে আসে। এতে ওই বাজারের অন্য সব জিনিসের বেচাবিক্রিও বেড়েছে। মোটরসাইকেলের নানা অনুষঙ্গের দোকানও বেড়েছে।

তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক ধনের ঝুঁকির মধ্যে তাদের লেনদেন করতে হয়। কারণ এই বাজারে কোটি টাকা লেনদেন হলেও নেই কোনো ব্যাংকের শাখা। একাধিক ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করেও লাভ হয়নি। ফলে তাদের বেশিরভাগ লেনদেন করতে হয়, পাঁচ থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের কাটাখালী বাজারে গিয়ে।

বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, ২০০৩ সালের শুরুর দিকে গ্রামের যুবক আরিফ মাহমুদের হাত ধরে শুরু হয় পুরোনো মোটরসাইকেল কেনাবেচার ব্যবসা। নিজ বাড়ির সড়কমুখী একটা ঘরে সাইনবোর্ডে লিখেন ‘এখানে মোটরসাইকেল বেচা-কেনা চলে’। ব্যবসা জমতে থাকায় আস্তে আস্তে দোকান থেকে করেছেন শোরুম। ২০০৫ সালে আরিফ, ফায়সাল আহম্মেদকে নিয়ে মোটরসাইকেলের শোরুম দেন মাহেন্দ্রা বাজারে। প্রথম দিকে প্রত্যন্ত গ্রামে মোটরসাইকেলের শোরুম দেখে লোকে হাসাহাসি করত। তবে প্রথম মাসেই মোটরসাইকেল বিক্রি করে ১৭ হাজার টাকা লাভ হয় তার। এরপর বাড়তে থাকে শোরুমে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। পরে আরিফকে দেখে অনেকেই নেমেছে এই ব্যবসায়। একটি শোরুম থেকে ২২ বছরে হয়েছে ৪৫টি শোরুম। এখন বাজারটিতে রমরমা মোটরসাইকেলের ব্যবসা।

মাহেন্দ্রা বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শোরুমগুলোতে মোটরসাইকেল কেনাবেচা হচ্ছে। কেউ দেখছেন, কেউ বা কিনছেন। কেউ দরদাম করছেন। এমন কর্মযজ্ঞ চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। তবে এই বাজারে বিকেলে জমজমাট বেচা-কেনা হয়। চলে মধ্যরাত পর্যন্ত।

মেসার্স আরিফ এন্টারপ্রাইজে গিয়ে বিক্রেতা আরিফ মাহমুদকে পাওয়া যায়নি। তার শোরুমে ৩০ থেকে ৩৫টি মোটরসাইকেল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দোকানে কেনাবেচা করছেন মো. আব্দুল্লাহ ও আব্দুল্লাহ সাকিব। তারা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এখানে পুরোনো মোটরসাইকেলের ব্যবসা আরিফের হাত ধরে শুরু হয়েছে। একটা দুইটা দোকান করতে করতে এখন এই মাহেন্দ্রা বাজারে ৪৫টি শোরুম রয়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ এখানে পুরানো মোটরসাইকেল কিনতে আসেন। বিক্রিও ভালো হয়।’

মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এখানে দেশি ও বিদেশি সবধরনের পুরোনো মোটরসাইকেল কেনাবেচার শোরুম রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয় ব্যান্ডের মোটরসাইকেল রয়েছে। অনেক সময় নতুন কন্ডিশনের মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। যেমন- কেউ এক মাস ব্যবহার করেছে। তারপর বিক্রি করেছে। এমন মোটরসাইকেলও পাওয়া যায়। তবে তুলনামূলক কম।’

মোহাম্মদ মটোর্সের বিক্রেতা সফিকুল ইসলামের শোরুমে ২০ থেকে ৩০টি মোটরসাইকেল সাজিয়ে রাখা আছে। তিনি বলেন, ‘বছরজুড়ে বেশি কেনাবেচা হয় দুই ঈদে। তার বাইরে তেমন হয় না। তবে যাদের পুরানো শোরুম। তাদের এখনও ভালো ব্যবসা হয়।’

তার শোরুমে মোটরসাইকেল দেখতে এসেছেন গোলাম রসুল নামের এক ব্যক্তি। পেশায় তিনি হাই স্কুলের শিক্ষক। তিনি বলেন, যাতায়াতের জন্য খুবই প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে মোটরসাইকেল কেনা। খরচ বাড়লেও সময় বাঁচে মোটরসাইকেলে। তিনি বলেন, ৮৫ হাজার থেকে ১ লাখের মধ্যে মোটরসাইকেল কেনার ইচ্ছে আছে। এখানে অনেকগুলো পুরানো শোরুম রয়েছে। আশা করি কেনা হবে।

ভাই ভাই এন্টারপ্রাইজের বিক্রেতা রায়হান আলী বলেন, এক বছর আগে দোকান দিয়েছি। ব্যবসা হচ্ছে মোটামোটি। তবে এখন ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামের দোকানগুলোতেও তিন-চার লাখ টাকার মতো সিকিউরিটি চার্জ দিতে হয়। এছাড়া চার হাজার টাকা দোকান ভাড়া। বিদ্যুৎ বিল ছাড়াও কর্মচারীর বেতন। সব মিলে কোনো মতে চলছে।

এখানকার শোরুমগুলোতে সপ্তাহে সাতদিনই খোলা থাকে। সাধারণত বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত চলে বেচা-কেনা। মোটরসাইকেল বেচা-কেনা এই বাজারে মোটরসাইকেল সারানোর জন্য একাধিক মেকানিকও দোকান বসিয়েছে।

স্থানীয় ও ক্রেতা বিক্রেতাদের মতে, এখানে পুরোনো মোটরসাইকেলের অনেকগুলো শোরুম এক সঙ্গে রয়েছে। এতগুলো শোরুম গোটা রাজশাহীতেও নেই। ক্রেতারা এখানে এসে দেখেশুনে কিনতে পারেন। দামও অনেক কম। এছাড়া নতুন গাড়ির দাম ও রেজিস্ট্রেশন খরচ বেশি। আর পুরোনো গাড়ির বেশিরভাগ রেজিস্ট্রেশন করা থাকে। শুধু অল্প টাকা খরচ করে নাম মালিকানা পরিবর্তন করলেই হয়ে যায়। এজন্য এখানে ক্রেতাদের ভিড় থাকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজশাহীর পুঠিয়া, দুর্গাপুর, বাগমারাসহ কয়েকটি উপজেলায় প্রচুর পানের চাষ হয়। পান এসব এলাকায় অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিচিত। এছাড়া এসব এলাকায় কৃষিতে সমৃদ্ধ। বিগত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে এই এলাকার মানুষ মাছ চাষেও সফল হয়েছেন। ফলে পান আর মাছ ব্যবসাকে পুঁজি করে তাদের হাতে প্রচুর টাকা থাকে। চলাফেরায় সুবিধা আর শখ মেটাতে অনেকেই মোটরসাইকেল কেনেন। শোরুমগুলোতে অনেক সময় কিস্তিতে, আবার বাকিতেও মোটরসাইকেল কেনাবেচা হয়।

মাহেন্দ্রা বাজার বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনারুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কাগজে কলমে মাহেন্দ্রা হাট হিসেবে ইজারা হয়। কিন্তু এখন বাজার নামে পরিচিত। রোববার ও বুধবার হাট বসত। কিন্তু এখন সারা সপ্তাহ হাটের চেয়ে বেশি মানুষ থাকে। পুরো বাজারে ১৭০টি দোকান রয়েছে। এর মধ্যে ৪৫টি মোটরসাইকেলের শোরুম রয়েছে। এক সময় একটি, দুটি থাকলেও এখন অনেক বেড়েছে। এর ফলে মাহেন্দ্রা বাজারের আলাদা একটা পরিচিতি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘তরুণদের কারণেই বাজারটি জমজমাট। তাদের ভালো ব্যবসা হয়। লেনদেনের জন্য আমরা বিভিন্ন সময় ব্যাংকের শাখা খোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সম্ভব হয়নি। এখানে মাসে কোটি টাকা লেনদেন হয়। একটা ব্যাংকের শাখা হলে ভালো হয়। এখানকার ব্যবসায়ীদের ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরের কাটাখালি বাজারে গিয়ে লেনদেন করতে হয়। সড়ক ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এতে ঝুঁকি বাড়ে।’

যেভাবে যাবেন

রাজশাহী শহর থেকে ১২ কিলোমিটার পূর্বে মাহেন্দ্রা বাজার। রাজশাহী শহর থেকে কাটাখালী পৌরসভা হয়ে পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়ন হয়েও আসা যায় মাহেন্দ্রা বাজারে। আবার নগরের নওদাপাড়া আমচত্বর হয়ে সরাসরি বাইপাস রাস্তা ধরেও আসা যায়। বাজারের ভেতরে দিয়ে পবা উপজেলা থেকে একটি রাস্তা পুঠিয়ার মাহেন্দ্রা বাজার হয়ে দুর্গাপুর উপজেলার দিকে চলে গেছে। 

আরকে