গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সরকারটারিতে এক বাড়ির আঙিনায় শোভা পায় রঙিন মাছের এক অনন্য জগৎ। সারি সারি কাটা চৌবাচ্চায় ভেসে বেড়াচ্ছে মলি, গাপ্পি, প্লাটি, কইকাপ, কমেট, গোল্ডফিশসহ নানা প্রজাতির ঝলমলে মাছ। সূর্যের আলোয় মাছগুলো দেখলে মনে হয় যেন প্রকৃতির আঁকা রঙিন ক্যানভাস। 

এই রঙিন মাছের খামারটি সাগর সরকারের। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে যিনি চাকরির পেছনে না ছুটে বেছে নিয়েছেন নিজের পথ। বর্তমানে তার খামারে রয়েছে প্রায় দুই লক্ষাধিক রঙিন মাছ। এখান থেকেই প্রতি মাসে গড়ে আয় করছেন ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা।

২০১৯ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে স্নাতকোত্তর শেষ করে সাগর ও তার দুই বন্ধু মিলে রঙিন মাছ চাষ শুরু করেন। কিন্তু শুরুতেই শীতের সময় পোনা মাছ মরে যায়, বন্ধুরা লোকসানের চাপে পিছু হটেন। একাই পথ চলতে থাকেন সাগর। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

সাগর বলেন, সব হারিয়েও আমি দমে যাইনি। আমি জানতাম, মন থেকে চেষ্টা করলে সফলতা আসবেই।

বাড়ির সামনে ৪৪ শতক জমিতে পুকুর ও সারি সারি চৌবাচ্চা তৈরি করে নতুনভাবে শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে সেই ছোট উদ্যোগ এখন এক পূর্ণাঙ্গ খামারে পরিণত হয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাগরের পুকুর ও চৌবাচ্চায় ঘুরে বেড়াচ্ছে মলি, প্লাটি, সোর্ডটেল, গাপ্পি, কমেট, জাপানি বাটারফ্লাই, জেবরা দানিয়া, গোরামি, এনজেল থাইটার, টাইগার বার্বসহ নানা প্রজাতির মাছ। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে মাছের খাবার দেওয়া, বাছাই ও বিক্রির ব্যস্ততা। স্থানীয় ক্রেতাদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও আসে অর্ডার।

আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাগর তৈরি করেছেন ওয়েবসাইট, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল। অনলাইনের মাধ্যমেই এখন দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে তার খামারের মাছ।

একেকটি রঙিন মাছের দাম ১৫ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফলে এখান থেকে নিয়মিত ভালো আয় হচ্ছে বলে জানান সাগর।

সাগরের বাবা মোজাফফর হোসেন বলেন, ছেলেটা চাকরি না করে এই কাজটা শুরু করেছিল, প্রথমে আমরা চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু এখন সে সফল। মানুষ তার খামার দেখতে আসে, এটা আমাদের জন্য গর্বের।

মাছ দেখতে আসা স্থানীয় যুবক রফিক ইসলাম বলেন, এরকম রঙিন মাছ টেলিভিশনে দেখেছি, কিন্তু পুকুরে বাস্তবে দেখিনি। সাগরের খামারে এসে সত্যিই অবাক হয়েছি। আমাদের গ্রামের জন্য এটা গর্বের বিষয়।

বর্তমানে সাগরের খামারে দুইজন স্থানীয় যুবক অস্থায়ীভাবে কাজ করছেন। ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তার। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬০০ কোটি টাকার রঙিন মাছের চাহিদা রয়েছে। আমি চাই গাইবান্ধাকে দেশের সবচেয়ে বড় রঙিন মাছ উৎপাদনকেন্দ্রে রূপ দিতে। সরকারের সহযোগিতা পেলে বিদেশেও রপ্তানি শুরু করতে পারব।

নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সাগর বলেন, চাকরির পেছনে না ছুটে তরুণরা যদি নিজ এলাকায় কাজ শুরু করে, তাহলে গ্রামেই কর্মসংস্থান তৈরি হবে। স্বপ্ন থাকলে, পরিশ্রমের ফল একদিন আসবেই।

সাগরের এই সফলতার পেছনে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এসকেএস ফাউন্ডেশন। তাদের আরএমটিপি প্রকল্পের মাধ্যমে সাগর পেয়েছেন প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও আর্থিক সহায়তা।

প্রকল্প কর্মকর্তা মোখলেছুর রহমান বলেন, সাগরের মতো তরুণরা যদি এগিয়ে আসে, তাহলে গ্রামেই তৈরি হবে কর্মসংস্থানের সুযোগ। আমরা তাকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।

আরকে