নামের সঙ্গে ‘বেগম’ জুড়ে দেওয়ায় আপত্তি
খুঁড়িয়ে চলছে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র, প্রতিশ্রুতি ফাইলবন্দি
অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে রয়েছে রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র। মহিয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্মভিটায় প্রতিষ্ঠিত স্মৃতিকেন্দ্রটি দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে অবহেলিত। নামমাত্র কার্যক্রম চলছে এখানে। আশার কথা অবহেলায় পড়ে থাকা রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রটি অবশেষে যুক্ত হচ্ছে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। এর ফলে আঁধার কেটে প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরবে, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দীর্ঘদিন সময় বঞ্চণার শিকার হওয়া রোকেয়ার জন্মভিটার মানুষ এখন আর কোনো আশ্বাসে আস্থা রাখতে চান না। তারা প্রতিশ্রুতির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে রোকেয়ার দর্শন বিকাশের সঙ্গে স্মৃতিকেন্দ্রটিকে আলোকিত দেখতে চান।
বিজ্ঞাপন
একইসঙ্গে রোকেয়ার নামের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া ‘বেগম’ শব্দের ব্যবহার নিয়েও আপত্তি রয়েছে তাদের। স্থানীয় সংগঠক ও গবেষকরা বলছেন, আজীবন ‘বেগম প্রথা’র বিরুদ্ধে রোকেয়া লিখেছেন-লড়েছেন, কিন্তু সেই ‘বেগম’ শব্দটি তারই নামের সঙ্গে ভুলভাবে সাঁটানো হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে রোকেয়া অনুরাগীদের।
বিজ্ঞাপন
আজ মঙ্গলবার (৯ ডিসেম্বর) মহিয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ১৪৪তম জন্ম এবং ৯২তম মৃত্যু দিবস। ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের খোর্দ্দ মুরাদপুর গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন নারী জাগরণের অগ্রদূত, মহিয়সী রোকেয়া সাখাওয়াত। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি কলকাতায় মারা যান। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
বাঙালির আধুনিক যুগের ইতিহাসে যে নারীর নাম গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়, তিনি রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। বাঙালি সমাজ যখন ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল, সেই সময় রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারীসমাজে শিক্ষার আলো নিয়ে এসেছিলেন। বাঙালি মুসলমান নারী জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পথিকৃৎ।
তার জীবন-কর্ম সর্ম্পকে গবেষণা, গ্রন্থাবলির অনুবাদ, প্রচার ও প্রকাশনা, সংস্কৃতি চর্চা এবং স্থানীয় যুবকদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবির প্রেক্ষিতে রোকেয়ার জন্মভিটায় ১৯৯৭ সালের ২৮ জুন তৎকালীন সরকার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং ২০০১ সালের ১ জুলাই রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উদ্বোধন করে।
এরপর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে স্থবির হয়ে পড়ে স্মৃতিকেন্দ্রের কার্যক্রম। ২০১৯ সালের দিকে এখানে সীমিত পরিসরে সংগীত, চিত্রাংঙ্কনসহ কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করা হয়। এরপর করোনার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। ২০২২ সালের দিকে আবারও সংগীত কোর্স চালু করলেও সেটি বেশি দিন চালানো সম্ভব হয়নি। রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় সংগঠকদের মনে।
রোকেয়ার জন্মভিটা দেখতে এসে ক্ষুদ্ধ দর্শনার্থীরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের কমতি নেই। তারা বলছেন, রোকেয়ার স্মৃতিবিজড়িত জন্মস্থান আজও পড়ে আছে অবহেলায়। সরকারের স্বদিচ্ছা, পরিকল্পনা ও উদ্যোগের অভাবে এখনো রোকেয়াচর্চা ও সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্রের দ্বারও রুদ্ধ। উদ্ধার হয়নি বেহাত হওয়া সম্পত্তি, মসজিদ, দিঘীসহ কোনো কিছুই। আঁতুর ঘরটিও হয়নি সংস্কার। রোকেয়ার দেহাবশেষ কলকাতা থেকে পায়রাবন্দে আনার প্রতিশ্রুতিও লালফিতাবন্দি।
রোকেয়া স্মৃতিকন্দ্র দেখতে আসা দর্শনার্থী মৌমিতা ইসলাম বলেন, রোকেয়ার কারণে আজ আমরা লেখাপড়া করতে পারছি। নারীরা বিভিন্নস্থানে চাকরি করতে পারছে। অথচ সেই রোকেয়ার প্রতি চরম অবহেলা করা হচ্ছে। জন্মভিটায় রোকেয়ার ঘরের দেয়ালগুলো বিলীনের পথে। শ্যাওলা জমে সব ইট নষ্ট হচ্ছে। আমরা চাই এখানে দর্শনার্থীবান্ধব পরিবেশ তৈরিসহ এগুলোকে সংরক্ষণ করা হোক।
স্থানীয় শামীম পারভেজ বলেন, পরিকল্পিত নানা অবকাঠামো দিয়ে সজ্জিত স্মৃতিকেন্দ্রটি। কিন্তু এখানে নেই কোনো কার্যক্রম। ভবনের প্রায় সব কক্ষগুলোই তালাবদ্ধ। বেশিরভাগ কক্ষের দরজা, জানালা নষ্ট হয়ে গেছে। অবকাঠমো আছে, জনবল আছে, নেই শুধু কার্যক্রম পরিচালনার উদ্যোগ। সরকার এত বড় অবকাঠামো কেন অযত্নে-অবহেলায় ফেলে রেখেছে জানি না। আমরা চাই এই স্মৃতিকেন্দ্রে বছরব্যাপী নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হোক। আমরা যেন ঘুরতে আসলে এখানে ভুতুরে পরিবেশ না পাই।
রোকেয়া ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিজিয়া পারভীন বলেন, সরকার চাইলে সবকিছুই সম্ভব। কিন্তু রংপুর নাম শুনে হয়তো চায় না। আমরা তো আজ পর্যন্ত একটা প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন দেখছি না। রোকেয়ার মরদেহ আনার কথা ছিল। দেড় দশক আগে সরকারিভাবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা রোকেয়ার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে চাই।
রোকেয়া স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম দুলাল বলেন, আমরা ভেবেছিলাম অন্তর্বর্তী সরকার এ স্মৃতিকেন্দ্রের উন্নয়ন করবে। কার্যক্রম চালু করতে পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু সেই আশা পূরণ হয়নি।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, প্রতিবছর রোকেয়া দিবসে প্রশাসনের কর্মকর্তারা রোকেয়ার দেহাবশেষ ভারত থেকে আনার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু সেই উদ্যোগ বাস্তবায়নে কোনো চিঠি চালাচালিও পর্যন্ত আমরা শুনি নাই। আমরা মনে করি পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণেই রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের প্রতি এত অবহেলা। এটা দুঃখজনক। কারো প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন নেই, সবই যেন ফাইলবন্দি।
এদিকে, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নামের বিকৃতি ও ভুলভাবে উপস্থাপন বন্ধে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়, নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলা একাডেমিসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সচেতন নাগরিক, সংগঠক ও গবেষকরা।
রংপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের (আরপিইউজে) সাধারণ সম্পাদক সরকার মাজহারুল মান্নান বলেন, যে বেগম প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। জীবন সংগ্রামে লেখালেখি করেছেন। সেই বেগম শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে তার নামের আগে। অথচ তিনি কখনোই নামের আগে বেগম লেখেননি। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা প্রতিষ্ঠান। চালু করা হয়েছে বেগম রোকেয়া পদক। এমনকি তার নামের ইংরেজি বানানটিও বিকৃত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, পারিবারিকভাবে রোকেয়ার নামের সঙ্গে কখনোই বেগম শব্দটি ছিল না। রোকেয়া বিয়ের পর তার স্বামীর নামের সঙ্গে মিল রেখে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন লিখতেন। যেহেতু রোকেয়া তার নামের সামনে বেগম যুক্ত করেননি। যিনি যে অংশ নামের সঙ্গে যুক্ত করেন না, সেটি তার নামের অংশ নয়।
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. শওকাত আলী জানান, ৯ ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমঝোতা সই হবে। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মাঝে রোকেয়ার জীবনকর্ম, প্রচার-প্রসার, গবেষণা ও চর্চায় নতুন দিগন্ত উন্মুক্ত হবে। সেখানে প্রতিদিন শিক্ষার্থীরা যাবে। আমাদের নতুন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
বাংলা একাডেমির সহপরিচালক ও বেগম রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবিদ করিম মুন্না বলেন, রোকেয়া স্মৃতিকেন্দ্রের উন্নয়নে নানা কার্যক্রম চলছে। আজ ৯ ডিসেম্বর থেকে এখানে শিশুদের চিত্রাঙ্কন, সংগীত ও নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণের উদ্বোধন হবে। এ ছাড়া রোকেয়ার জীবনের উপর বই নিয়ে লাইব্রেরিকে সমৃদ্ধ করা হয়েছে। প্রতিদিনই স্মৃতিকেন্দ্রে দর্শনার্থীদের পদাচারণা ও লাইব্রেরিতে বইপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের আনাগোনা বাড়ছে বলেও জানান তিনি।
উল্লেখ্য, রোকেয়া দিবস উপলক্ষে বাংলা একাডেমি দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করবে। মঙ্গলবার সকালে রোকেয়ার জন্মভিটার বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, দুপুরে আলোচনা সভা এবং বিকেলে শিশু কিশোরদের চিত্রাঙ্কন, সংগীত ও নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হবে। এ ছাড়া, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে দিনব্যাপী কর্মসূচিতে রয়েছে র্যালি, আলোচনা সভা, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।
এএমকে