শারীরিক প্রতিবন্ধী রতন সাহা শারীরিক ও মানসিক জোরেই কাজ করেন

জন্মগতভাবেই তার দুই পায়ের পাতা ও ডান হাতের তিনটি আঙুল নেই। পঙ্গু হাত-পা নিয়ে তার বেড়ে ওঠা। তাতে কি, তার অদম্য ইচ্ছার কাছে হেরেছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। এসব জয় করে ইতিমধ্যেই নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলেছেন নওগাঁর রতন সাহা (৪০)। বাকি জীবনটুকু কাজ করেই কাটাতে চান তিনি। তাই খেতখামারে কাজ, ইট ভাঙা ও কাঠ কাটা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে প্রতি মাসে তিনি আয় করেন চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।

নওগাঁ বদলগাছি উপজেলার বালুভরা ইউনিয়নের হযরতপুর এলাকার মৃত ধিরেন্দ্রনাথ সাহার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার বড় রতন সাহা। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় এবং সংসারের কাজে মনোনিবেশ করায় ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি তার।

আমার ইচ্ছে ছিল আমার জীবনে এমন কিছু একটা করব, সবাই বলে যেন আমি প্রতিবন্ধী হলেও কাজে ভালো ছেলে। আমি কখনো নিজেকে দুর্বল ভাবি না। অন্য মানুষের মতোই নিজেকে মনে করি। আর কাজ করে যাই মায়ের স্বপ্ন পূরণে।

অদম্য রতন সাহা

কাজ করতে কোনো সমস্যা হয় কি না, এমন প্রশ্নে রতন সাহা জানান, কাজের প্রতি অনেক আগ্রহ তার। তিনি উচ্চতায় তিন ফুট দুই ইঞ্চি। তবু ভিক্ষাবৃত্তি নয়, শারীরিক পরিশ্রমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে নিজে কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত থেকেই হাটে, মাঠে, ঘাটে কাজ করে যান। ছোটবেলায় বিছনাবন্দীর এক প্রতিবন্ধীকে দেখে প্রেরণা পান। ভাবেন, সে যদি বিছানায় থেকে কাজ করতে পারে, তবে তিনি কেন পারবেন না?

অদম্য রতন সাহা বলেন, আমার ইচ্ছে ছিল আমার জীবনে এমন কিছু একটা করব, সবাই বলে যেন আমি প্রতিবন্ধী হলেও কাজে ভালো ছেলে। আমি কখনো নিজেকে দুর্বল ভাবি না। অন্য মানুষের মতোই নিজেকে মনে করি। আর কাজ করে যাই মায়ের স্বপ্ন পূরণে।

মায়ের সঙ্গে রতন সাহা

রতন সাহার মা উষা বালা সাহা বলেন, আমার পাঁচ ছেলে-মেয়ের মধ্যে বড় ছেলেকে নিয়ে আমি সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকি। কিন্ত এখন আমি আমার এই প্রতিবন্ধী ছেলের জন্য গর্ব করি। সবাই এখন কর্মঠ রতনের মা বলেই আমাকে চেনেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে রতনের মা বলেন, সরকার সবাইকে দান করে। এই ছেলেটিকে একটু সহযোগিতা করুন। আমার ছেলে ভিক্ষা করে না। জন্ম থেকে হাত-পা নেই। ভারী কাজ করতে হয়। একদিন কাজ না করলে আমাদের খুব কষ্ট হয়। সমাজের বিত্তবানদের কাছে মিনতি করছি, ছেলেটির জন্য একটা হুইলচেয়ার পেলে তার ওপর বসে কাজ করতে পারতেন।

বালুঘরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শেখ মো. আয়েন উদ্দিন বলেন, রতন শারীরিক প্রতিবন্ধী। ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়’―এমন প্রবাদ বাক্যের দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ জীবনযুদ্ধে লড়াকু সৈনিক ৪০ বছর বয়সী রতন সাহা।

প্রতিবেশী বিমান চন্দ্র ঘোষ বলেন, রতন প্রতিবন্ধী। কিন্তু কেউ সাহায্য-সহযোগিতা দিলেও নেন না। মাঠেঘাটে কষ্ট করে যা আয় করেন, তা মায়ের হাতে তুলে দেন। তাদের সংসার খুব কষ্ট করে চলে। সরকার যদি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা দেয়, তাহলে খুব ভালো হতো।

শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু রতন নন, জেলার সব প্রতিবন্ধী যেন স্বাবলম্বী হতে পারেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সে ব্যবস্থা করা হবে।

হারুন-অর রশিদ, জেলা প্রশাসক

আরেক প্রতিবেশী উষা রানী সাহা বলেন, ছেলেটির হাত-পা নিয়ে চলাফেরা করতে খুব কষ্ট হয়। কাজ করে যা কিছু পায়, মায়ের হাতে দেয়। আর হাত-পা না থাকায় কষ্ট না করলে খেতে কে দেবে? সারা দিন কাজকর্ম করে যা পায়, তা-ই দিয়ে সংসার চলে।

বালুভরা ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, রতন নিয়মিত প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন এবং আমি নিজ উদ্যোগে সব সময় খোঁজখবর রাখি। তিনি প্রতিবন্ধী হয়েও ভিক্ষাবৃত্তি না করে মাঠেঘাটে দিনমজুরের কাজ করেন। তার সংগ্রামী জীবন দেখে এলাকাবাসী তাকে ভালোবাসেন।

বালুভরা ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্য দিলরুবা ইয়াসমিন বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করার আগেই মানবিক দিক বিবেচনা করে তাকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। মা-ছেলেকে প্রতিবন্ধী ভাতা দিয়েছি।

এ বিষয়ে নওগাঁ জেলা প্রশাসক হারুন-অর রশিদ বলেন, শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু রতন নন, জেলার সব প্রতিবন্ধী যেন স্বাবলম্বী হতে পারেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সে ব্যবস্থা করা হবে।

এনএ