দাদনের টাকা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর চার জেলেকে চায়ের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানোর পর ঘুমন্ত অবস্থায় বঙ্গোপসাগরে ফেলে হত্যার ঘটনা ঘটে। হত্যার নেপথ্য কারিগর চট্টগ্রামের ফিশারিঘাটের আড়তদার ইউছুফ মিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে এক লাখ টাকা নিয়ে চার জেলেকে হত্যা করা হয়। এদিকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত এক জেলে আল আমিন এলাকায় ফিরে চার জেলে নিহত হওয়ার আষাঢ়ে গল্প বানিয়ে প্রচারণা চালান। তবে দীর্ঘ তদন্তের পর হত্যাকাণ্ডের আসল রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড শেষে তারা এখন জেলা কারাগারে রয়েছেন।

সোমবার (১৯ জুলাই) সন্ধ্যায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও লক্ষ্মীপুরের রামগতির বড়খেড়ি নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) মো. বেলাল হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, গ্রেফতার আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গোপনীয়তা রক্ষা করে জড়িত অন্য দুজনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হলেন রামগতি উপজেলার সোনালী গ্রামের নাসির উদ্দিন মাঝি (৪৬), তার ছেলে মো. রিয়াজ (১১), নোয়াখালীর চরজব্বর এলাকার আবদুল মালেকের ছেলে মো. করিম (৪৬), একই এলাকার আমির হোসেনের ছেলে মো. মিরাজ (১৭)।

গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন চট্টগ্রামের বাকলিয়া নতুন ফিশারিঘাট এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে আড়তদার ইউছুফ মিয়া, যশোরের চৌগাছার দক্ষিণ কয়ারপাড়া এলাকার মতিউর রহমানের ছেলে মো. রাসেল, লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের পূর্বচরফলকন গ্রামের আবু আবদুল্লাহর ছেলে আল আমিন। বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ড শেষে তারা জেলা কারাগারে রয়েছেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গেল বছরের অক্টোবরে চট্টগ্রামের বাকলিয়া নতুন ফিশারিঘাটের আড়তদার ইউছুফ মিয়ার কাছ থেকে রামগতির নাসির উদ্দিন ৩ লাখ টাকা দাদন নেন। এরপর থেকেই নাসির নিয়মিত ওই আড়তে মাছ বিক্রি করতেন। পরে অভাব-অনটনে পড়ে তিনি একই মাছঘাটের অন্য আড়তদারের কাছ থেকে দাদন নেন। এতে ইউছুফ ক্ষিপ্ত হয়ে চলতি বছরের ১২ মে ট্রলারসহ নাসিরকে ঘাট এলাকায় আটকে রাখেন। কিন্তু কৌশলে ট্রলার নিয়ে নাসির পালিয়ে রামগতি চলে আসেন। এ নিয়ে নাসিরকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এতে তাকে (নাসির) হত্যা করার জন্য এক লাখ টাকায় রাসেল, সুমন, সোহাগ ও আল আমিনের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। 

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানান, হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে ১৬ মে চুক্তিকারী ওই চারজন রামগতির স্লুইসগেট বাজারের একটি দোকান থেকে ১০টি ঘুমের ট্যাবলেট কেনেন। ১৭ মে নাসিরসহ ৪ জেলে ও তারা মেঘনায় মাছ শিকারে যান। নদীতে মাছ কম ধরা পড়ছে, তাই বেশি মাছ ধরার অজুহাতে নাসিরকে তারা (চুক্তিকারীরা) উদ্বুদ্ধ করে বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় নিয়ে যান। ২০ মে ইউসুফের সঙ্গে যোগাযোগ করে হত্যার পরিকল্পনা করেন চারজন।

পরে ঘুমের ওষুধ মেশানো চা খাওয়ানো হয় নাসির, রিয়াজ, করিম ও মিরাজকে। আস্তে তারা ঘুমিয়ে পড়েন। এরপর তাদের সাগরে ফেলে হত্যা করা হয়। চুক্তিকারীরা ফিশারিঘাট এলাকায় ইউছুফের কাছে গিয়ে ট্রলার হস্তান্তর করে। পরে আল আমিন রামগতি ফিরে এসে তাদের পরিবারকে জানান, ট্রলারে জলদস্যুরা হামলা করে নাসিরসহ চার জেলেকে হত্যা করে। কোনোরকমে তারা পালিয়ে এসেছেন। তার বর্ণনা শুনে বিশ্বাস করেছিলেন গ্রামবাসী। এ খবরে ২৭ মে নাসিরের স্ত্রী মীরজাহান বেগম রামগতি থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

এসপি জানান, মীরজাহানের মোবাইল ফোনে ১৩ জুন হঠাৎ হত্যাকারী রাসেল ফোন করেন। এ সময় বলা হয়, নাসিরসহ চার জেলে তার (রাসেল) হেফাজতে রয়েছেন। এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিলেই তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। ঘটনাটি মীরজাহান থানা পুলিশকে জানান। পরে লিখিত অভিযোগ দিলে ঘটনাটি বড়খেরী নৌ-পুলিশকে তদন্তের জন্য দেওয়া হয়। এরপর ১৫ জুন মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে যশোরের চৌগাছা থেকে হত্যাকারী রাসেলকে আটক করা হয়।

তার দেওয়া তথ্যমতে, কমলনগরের হাজিরহাট থেকে আল আমিন ও হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী আড়তদার ইউছুফকে চট্টগ্রামের বাকলিয়া থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরে তাদের আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড চায় পুলিশ। এতে ইউসুফের সাত, রাসেল ও আল-আমিনের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনার সত্যতা বেরিয়ে আসে।

এ বিষয়ে মীরজাহান বেগম বলেন, পেটের টানে আমার স্বামী ও ছেলে অন্যদের সঙ্গে নদীতে গেছেন। পরিকল্পিতভাবে তাদের চারজনকে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশের তদন্তে হত্যার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। আমি হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।

বড়খেরী নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোবাইল ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে ঘুমন্ত চার জেলেকে সাগরে ফেলে হত্যা করার রহস্য উদঘাটিত হয়েছে। হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আসামি সুমন ও সোহাগকে গ্রেফতারে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

হাসান মাহমুদ শাকিল/এনএ