টিনের ছাউনি ও বস্তা-কাগজের বেড়া দেওয়া একটি বেষ্টনী। ঝড়-বৃষ্টি, শীত-গ্রীষ্ম— সবই যায় মাথার ওপর দিয়ে। ভেতরে একটা কাঁঠালগাছে শিকলবন্দি অবস্থায় দিনে বসে বসে প্রলাপ বকেন। রাতে এখানেই মশারি খাটিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। প্রায় ৯ বছর ধরে এভাবেই কাটছে রাসেলের অস্বাভাবিক জীবন।

রাসেল জয়পুরহাট সদর উপজেলার জয়পুরহাট পৌরসভার গৌড়ীপাড়া এলাকার মো. লুৎফর রহমানের ছেলে। চার সন্তানের মধ্যে তিন নম্বর সন্তান রাসেল মানসিক ভারসাম্যহীন। এদিকে অর্থাভাবে সন্তানের চিকিৎসা করতে পারছেন না বাবা-মা।

সরেজমিনে তাকে দেখতে গিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে তিনি গেয়ে ওঠেন, ‘হৃদয়ে যতটুকু ভালোবাসা আছে, মরণেও থাকে যেন শুধু তোমারই। হৃদয় থেকে তুমি, মনের মাঝে তুমি। তুমি সাথী আমার, আমিও আছি তোমার। হৃদয়ে যতটুকু ভালোবাসা আছে, মরণেও থাকে যেন শুধু তোমারই। তুমিই তুমি... হৃদয় মাঝে আমার, স্বপনেও তুমি...।’ গানটি গাইছিলেন শিকলবন্দি মো. রাসেল মাহমুদ।

পরিবারের সদস্যরা জানান, রাসেল একজন দক্ষ ও ভালো কাঠমিস্ত্রি ছিলেন। তার বড় ভাই উজ্জ্বলের সঙ্গে কাজে যেতেন তিনি। প্রায় ২০ বছর আগে একদিন কাজে গিয়ে অস্বস্তিবোধ করেন এবং বড় ভাইকে বলেন, আমার কোনো কিছু ভালো লাগছে না, বাড়ি যাব। এ কথা বলার পর বড় ভাই তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। এরপর থেকে দিন যত যায়, ততই অস্বাভাবিক আচরণ ও মানসিক পরিবর্তন হয়। 

মাঝেমধ্যে এদিক-সেদিক চলে যেতেন। যাকে-তাকে মারধর করতেন। জিনিসপত্র ভাঙচুর করতেন। পরিবারের সদস্যরা উপায় না পেয়ে একদিন টিনের ছাউনি, বস্তা ও কাগজের বেড়া দিয়ে একটি ঘর করে এর ভেতর শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। প্রায় ৯ বছর ধরে শিকলেই বাঁধা আছেন রাসেল।

রাসেলের মা জোৎস্না বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার ছেলেকে হাত-পা বেঁধে রাখিচি, ঠিকমতো খেতে দিতে পারি না। ওষধ-বড়ি দিতে পারি না। তাকে বাইরে রেখে আমি ঘরে অনেক কষ্টে থাকি। তার ওপর দিয়ে ঝড়বৃষ্টি যায়, পানি-কাদোর মধ্যে বসে থাকে। চিল্লাচিল্লি করে। আবার তাকে ধরে ধরে খাওয়াই দিতে হয়। খুব কান্নাকাটি করে, আমার আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। নিজেই চলতে পারি না। এই ছলকে নিয়ে বহু কষ্টে থাকি। দেখার মতো কেউ নেই, কোনো সাহায্যও পাই না।

রাসেলের বাবা মো. লুৎফর রহমান বলেন, রাসেলকে নিয়ে কী করব বুঝতে পারছি না। বাইরে বের হয়ে তাকে দেখলে আমার কাঁদোন আসে। কিছু বলতে পারি না। ছেলের কষ্ট আমি সহ্য করা পারি না। ম্যালা টাকাপয়সা খরচ করিচি। আমার আর সে রকম আর্থিক অবস্থা নেই। এখন খুব অসহায় হয়ে গেছি। সরকার যদি কোনো দিন আমার দিকে মুখ তুলে তাকায়, তাহলে ছেলেটার চিকিৎসা করা সম্ভব হবে। তা ছাড়া আমি আর পারতেছি না।

ছোট ভাই মো. রাশেদ মাহমুদ বলেন, রাসেল মাহমুদ আমার বড় ভাই। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে মানুষ হইছি। সে আমার সঙ্গে অনেক বন্ধুসুলভ আচরণ করেছে এবং আমার কখন কী লাগত, সব চাহিদা সে মিটায়ত। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে কী হয়ে গেল জানি না। ৮-৯ বছর থেকে শিকলে বাঁধা আছে সে। আমরা তার চিকিৎসা করতে করতে নিঃস্ব হয়ে গেছি। সরকারিভাবে আর্থিক সহযোগিতা পেলে তার সুচিকিৎসা করতে পারব।

বড় ভাই মো. উজ্জ্বল বলেন, টাকা আগে নয়, আমার ভাই আগে। এ জন্য তার পেছনে অনেক টাকা খরচ করেছি। কিছু জমি ছিল, তার অংশও বিক্রি করা হয়েছে। তবু সুস্থ করতে পারিনি। এখন আমরা নিরুপায় হয়ে গেছি।

প্রতিবেশী মো. নাজমুল হোসেন বলেন, আমি ৮ থেকে ৯ বছর ধরে দেখছি রাসেল ভাই শিকলবন্দি হয়ে আছেন। এ যুগে এভাবে থাকা অনেক কষ্টকর। তার যখন থেকে মাথার এই সমস্যা, তখন থেকে তার পরিবার অনেক চেষ্টা করেছে। উন্নত চিকিৎসা করাতে অনেক টাকার প্রয়োজন, কিন্তু এই দরিদ্র পরিবারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। সরকার বা দানশীল কারও কাছে যদি কোনো সুবিধা পান, তাহলে তিনি হয়তো সুস্থ হয়ে যাবেন।

জয়পুরহাট পৌরসভার ২ নং সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পাপিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাসেলের শিকলবন্দির বিষয়টি আমি জানি। তাকে দেখেও এসেছিলাম। আমার খুব খারাপ লেগেছে। তাকে শিকল ছাড়া রাখলে সবাইকে মারধর করে। ভাঙচুর করে। অন্যত্র চলে যায়। তারপরও তাকে একটি ভালো ঘরে রাখবে তাও না। এমন অমানবিকভাবে রাখা হয়েছে, এটা খুবই কষ্টকর।

জয়পুরহাট পৌরসভার প্যানেল মেয়র ও ওই এলাকার কাউন্সিলর মো. দেওয়ান ইকবাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গৌড়ীপাড়ার রাসেল মানসিকভাবে কখনো ভালো, কখনো খারাপ থাকে। নয় বছর ধরে শিকলবন্দি কি না খবর নেব। পৌরসভার পক্ষ থেকে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেওয়া আছে।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরাফাত রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমাজসেবার মাধ্যমে তাকে চিকিৎসার জন্য সরকারিভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করা হবে। শিকলে বেঁধে রাখা একটি অমানবিক বিষয়। তাকে কেন বেঁধে রাখা হয়েছে, সমাজসেবার মাধ্যমে খবর নিয়ে বিষয়টি দেখব।

এনএ