স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর সংসার চালাতে খেয়া নৌকার হাল ধরেন। চার সন্তানের মুখে একমুঠো খাবার তুলে দিতে শুরু করেন মানুষ পারাপার। এভাবেই টানা ১৮ বছর ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার গোপীনাথপুরের মৃত সুবাস চন্দ্র দাসের স্ত্রী চপলা রাণী দাস।  

জানা গেছে, চপলা রাণী দাসের স্বামী সুবাস চন্দ্র দাস মারা যাওয়ার সময় দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে যান। বড় মেয়ে সরস্বতী চন্দ্র দাসের বিয়ে হয়েছে টাঙ্গাইলে। আর বড় ছেলে সঞ্জীব চন্দ্র দাসও বিয়ে করে বউ নিয়ে টাঙ্গাইলে থাকেন। সেখানে একটি কাঠমিস্ত্রির দোকানে কাজ করেন তিনি। ছোট মেয়ে তুলশী রাণী দাস ও ছোট ছেলে আকাশ চন্দ্র দাসকে নিয়ে স্বামীর ভিটায় বসবাস করছেন চপলা। ১৮ বছর ধরে খেয়া নৌকা চালান তিনি।

নদীর দুই পাড়ের রাস্তা পাকা হওয়ায় মানুষজন এখন খেয়ায় কম পারাপার হয়। ফলে কমে গেছে চপলার আয় রোজগার। এক সন্তানকে কাপড়ে বেঁধে, আরেক সন্তানকে নৌকায় শুইয়ে রেখে শুরু হয়েছিল তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বর্তমানে দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে সংগ্রামী এই নারীর দিন কাটছে খুবই কষ্টে। শতকষ্ট করেও জীবনের চাকা বদলাতে পারেননি তিনি। পঞ্চাশোর্ধ্ব চপলাকে এখনো বাইতে হচ্ছে খেয়া নৌকা।  

সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার গোপীনাথপুর উত্তরপাড়ার মনু পীরের দরবার এলাকায় ইছামতি নদীর দুই পাড়ের মানুষজনকে নৌকা দিয়ে পারাপারে ব্যস্ত খেয়ার মাঝি চপলা। গোপীনাথপুর ও ঝিটকা নতুন বাজার এ দুই এলাকার লোকজন খেয়া পারাপার হয়। লগি আর বৈঠা দিয়ে নৌকা বেয়ে এপার থেকে ওপার যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন চপলা। তার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ। খেয়া পারাপারের সময় কোনো যাত্রী লগি ধরে আবার কেউ বৈঠা দিয়ে নৌকা চালিয়ে তাকে সহযোগিতা করছেন। 

খেয়াঘাট থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে চপলা রাণী দাসের বাড়ি গিয়ে দেখা গেছে, জরাজীর্ণ একটি দোচালা ঘর। এই ঘরেই সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন তিনি। ঘরের চালার টিনগুলো ফুটো হয়ে গেছে। বৃষ্টি হলে পানি পড়ে। বেশ কয়েক বছর আগে একটি এনজিও ঘরটি করে দিয়েছিল। তবে বর্তমানে এই ঘর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। অর্থাভাবে মেরামত করতে পারছেন না তিনি। 

চপলা রাণীর বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় বাসিন্দা লাভলী আক্তার ঢাকা পোস্টকে জানান, তার কোনো জায়গা জমি নেই। থাকার মতো ভালো একটা ঘরও নেই। টাকার অভাবে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছেন না। একজন নারী হয়েও নৌকা চালিয়ে অনেক কষ্টে সংসার চালাচ্ছেন। স্বামীর রেখে যাওয়া এই নৌকাই তার একমাত্র সম্বল। প্রধানমন্ত্রী যদি তাকে একটু সহযোগিতা করেন তাহলে তিনি মেয়েটাকে বিয়ে দিতে পারবেন। 

গোপীনাথপুর মজমপাড়ার মো. কালাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, উনি খুব দরিদ্র মানুষ। খেয়া পারাপার করে যা পান তা দিয়ে চলে তার সংসার। এলাকার মানুষ যা দেয় তাই নেন, তার কোনো চাহিদা নেই। তাকে আমরা বছরে কিছু ধান দিয়ে পারাপার হই।

স্থানীয় বাসিন্দা জহিরুল ইসলাম আকাশ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৮ বছর আগে ব্রেইন স্ট্রোকে তার স্বামী মারা যান। এরপর থেকে তিনি খেয়া নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার করে চলছেন। দুই পাশের রাস্তা পাকা হওয়ার কারণে খেয়ায় লোকজন কম পারাপার হয়। যে কারণে তার আয় রোজগার কমে গেছে। টাকার অভাবে তিনি সন্তানদের পড়াশোনা করাতে পারেননি। বয়সের কারণে তার খেয়া নৌকা বাইতে অনেক কষ্ট হয়। এই বয়সে আর কত দিন তিনি এই পেশায় থাকতে পারবেন তা নিয়েও শঙ্কা আছে। সরকারিভাবে কোনো অনুদান দিলে বা স্থায়ীভাবে তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হলে তার জন্য ভালো হবে। 

হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান আবুল বাশার সবুজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, চপলা রাণী একজন সংগ্রামী নারী। তাদের আদি পেশা খেয়া পারাপার করা। তবে এখন তার জীবিকা নির্বাহ করা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। সরকারিভাবে পুনর্বাসন বা আর্থিক সহযোগিতা করা হলে তিনি উপকৃত হবেন। 

মাঝি চপলা রাণী দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই পাশে রাস্তা হইয়া গেছে। আগের মতো কামাই নাই। সারাদিন খেয়া পারাপার করে যা কামাই করি তা দিয়ে সংসার চালাইতে কষ্ট হয়। পোলাপানের খাবারই দিতে পারি না ঠিকমতো। আমি খুব দুরাবস্থায় আছি। নিজের কষ্টের কথাগুলো না পারছি কাউকে বলতে না পারছি মরতে। 

তিনি আরও বলেন, ‘আমার কষ্টভরা জীবনের গল্প মানুষরে বোঝানোর উপায় নাই। টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছি না। আমার সামর্থ্যও নাই, কীভাবে কী করমু জানি না। লোকজন যদি আমারে সহযোগিতা করে তাইলে মেয়ে বিয়ে দিতে পারুম। খেয়া চালিয়ে কিছু ধান পাই আর এলাকার লোকজন কিছু টাকা দেয়। এই দিয়ে কি আর চলে?’

চপলা রাণী বলেন, ‘নিজের চার শতাংশ জায়গা আছে। ঘরটি জরাজীর্ণ কিন্তু মেরামত করার সামর্থ্য নেই। অনেক কষ্টে দিন কাটছে। দুই বছর হলো বিধবা কার্ড পাইছি। সরকার যদি স্থায়ীভাবে কিছু করে দিত তাহলে আমি সন্তানদের নিয়ে কোনো রকমে চলতে পারতাম। জানি না এই কষ্ট থেকে কবে মুক্তি মিলবে আমার।’ 

হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, `বিভিন্ন গণমাধ্যম ও স্থানীয়দের মাধ্যমে বিষয়টি জানার পরে চপলা রাণীকে কয়েকদিন আগে জরাজীর্ণ ঘরটি মেরামত করার জন্য এক বান টিন ও আট হাজার টাকা নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। চপলা রাণীর বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছি। আগামীতে তাকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।' 

আরএআর/জেএস