প্রতিদিনের মতো কর্মব্যস্ততা সেরে ঘরে ফেরেন আরিফ। রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েন তিনি। তখন তার শরীরে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করতে থাকে। ভেবেছিলেন গ্যাস্ট্রিক বা এসিডিটি থেকে এমন সমস্যা হচ্ছে। হুট করে রাত ৩টার দিকে বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন। যন্ত্রণাময় এ ব্যথা সইতে না পেরে বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠেন আরিফ।

বুকের ব্যথা যেন তার বাম হাতে ছড়িয়েছে। শরীর ও মাথা থেকে ঘাম ঝরতে থাকে। নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে সহকর্মীদের ডেকে নিয়ে বুকব্যথার কথা জানান। তাদের দেওয়া প্রাথমিক চিকিৎসাতে ব্যথা না কমায় ছুটে যান হাসপাতালে। এরপর জানা গেল তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত।

ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় এভাবেই নিজের হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ তুলে ধরেন এসএম আরিফুজ্জামান ওরফে আরিফ। ৪৮ বছর বয়সী এই ব্যক্তি বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করেন। পাশাপাশি তিনি একজন সংস্কৃতিকর্মী। তার গ্রামের বাড়ি রংপুর নগরীর স্টেশন রোড ছালেক মার্কেট-সংলগ্ন এলাকায়। কিন্তু চাকরির কারণে কুড়িগ্রামের উলিপুরে সহকর্মীদের সঙ্গে মেসে থাকতেন।    

২০২০ সালের ২ নভেম্বর হার্ট অ্যাটাকের আগে আরিফ কিছু লক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন। যা ছিল হার্ট অ্যাটাকের সংকেত। ওই সংকেত বুঝে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ায় সেদিন ভয়ংকর কোনো পরিণতি থেকে বেঁচে যান তিনি। সহকর্মীদের সহযোগিতায় আরিফ প্রথমে কুড়িগ্রামে চিকিৎসা নেন।

প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে হার্ট অ্যাটাকের বিষয়টি নিশ্চিত করেন চিকিৎসক। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন চিকিৎসক। সেখানে ভর্তি হওয়ার পর সিসিইউতে রেখে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

পরবর্তীতে ঢাকায় ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে তার তিনটি ব্লকে অস্ত্রোপচার (রিং পরানো) করা হয়। বর্তমানে তিনি হার্ট সুস্থ রাখতে নিয়মিত স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ করছেন। সঙ্গে নিয়মিত ব্যায়াম করা, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং চিকিৎসকের নিয়মিত পরামর্শ গ্রহণ করছেন।

রংপুর ও ঢাকায় প্রাথমিক চিকিৎসা থেকে শুরু করে ইসিজি, এনজিওগ্রাম ও অস্ত্রোপচার মিলে তার হার্ট অ্যাটাকের প্রথম ধাক্কায় চার লাখ টাকা খরচ হয়েছে। বর্তমানে তিনি চিকিৎসকের দেওয়া নিয়মে ওষুধপত্র সেবন করছেন, জানান আরিফুজ্জামান।
 
আক্রান্ত হওয়ার প্রথমদিনের কথা স্মরণ করে আরিফ বলেন, ‘বিপদ কখনো বলে-কয়ে আসে না। বলা নেই কওয়া নেই, হুট করে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়েছে, এমনটা আমরা প্রায়ই শুনি। তবে বেশির ভাগ সময় হার্ট অ্যাটাকের আগে আমাদের শরীর সংকেত দেয়। প্রথমে বুকে অল্প ব্যথার সঙ্গে একটা অস্বস্তি থাকে। ওই সংকেত বুঝে পদক্ষেপ নিলে ভয়ংকর কোনো পরিণতি থেকে বেঁচে যাওয়া যায়।’

তার দাবি, কিছু লক্ষণ রয়েছে যা জানা থাকলে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে আগে থেকেই সতর্ক হওয়া যায়। বুকে ব্যথা বা অস্বস্তি পুরুষ ও নারী উভয়ের ক্ষেত্রে হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম লক্ষণ। হঠাৎ করে মুখ, হাত-পা, বিশেষত শরীরের এক পাশে দুর্বলতা বা অচল অনুভূত হতে থাকে। যদি কেউ দীর্ঘদিন এমন লক্ষণ অনুভব করতে থাকে, তার দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

শুধু চিকিৎসা করে হার্ট ভালো রাখা যায় না বলে জানান আরিফ। তিনি বলেন, আমরা যারা হার্টের রোগী তাদের অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত। নয়তো ঝুঁকি থেকেই যায়। হার্ট ভালো রাখতে হলে নিয়মিত হাঁটা বা ব্যায়াম করা, সঙ্গে স্প্রে রাখা, নিয়মিত ওষুধ সেবন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করা জরুরি।

মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক ঢাকা পোস্টকে জানান, বিভিন্ন কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়। এ জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় ও বয়স নেই। তবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও মানসিক চাপ হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম কারণ। অনেক সময় রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকলে করোনারি রক্তনালি ব্লক হয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তবে প্রাথমিক লক্ষণ বা হার্ট অ্যাটাকের সংকেত অনুভব হলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ ও দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া জরুরি।  

তিনি বলেন, হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধযোগ্য। সচেতনতা, সতর্কতা এবং নিয়মানুবর্তিতা এই রোগের প্রধান প্রতিষেধক। এ জন্য যা মানতে হবে : হার্ট অ্যাটাক বা হৃদরোগের শত্রু হচ্ছে ধূমপান, তাই ধূমপান থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন। ধূমপানের মতো মাদকও হৃদরোগের আরেকটি কারণ, তাই মাদককে না বলুন। অযথা দুশ্চিন্তা করবেন না। নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করুন। মাঝে মাঝে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। শরীরের রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করুন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন। নিয়মিত হাঁটাচলা ও ব্যায়াম করে নিজেকে সুস্থ রাখুন। প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি খান।

প্রতি বছর বিশ্বে হৃদরোগে সবচেয়ে বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। করোনাক্রান্তির ১৮ মাসে প্রচলিত স্বাস্থ্যসেবা করোনাকেন্দ্রিক হওয়ায় হৃদরোগীদের সেবা বিপাকে পড়েছে। এমতাবস্থায় হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি করা জরুরি। সঙ্গে হৃদরোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ডিজিটাল প্লাটফর্মের ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে বলে জানান তিনি।

এমএসআর