তৎকালীন সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন ছিলেন কুড়িগ্রাম জনপদের একটি বিশ্বস্ত নাম। আমলাতান্ত্রিক কার্যাবলির বাইরে সামাজিক ও মানবিক কাজে তার অবদানে অভিভূত ও সর্বজনস্বীকৃত হলেও অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনায় চাকরিজীবনে টানাপোড়েনে পড়েন তিনি।

অবশ্য সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে নিজের আস্থা ও বিশ্বাসে অটল ছিলেন সুলতানা পারভীন। সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না থেকেও হয়েছিলেন মামলার আসামি। পরে অবশ্য সব দিক বিবেচনা করে সুলতানা পারভীনকে দেওয়া লঘু দণ্ড মওকুফ করেছেন রাষ্ট্রপতি। এ সিদ্ধান্তে কুড়িগ্রামের সব পর্যায়ের মানুষ, বিশেষ করে জনসাধারণের মাঝে স্বস্তির নিশ্বাস আসে।

জানা যায়, ডিসি সুলতানা পারভীনের কার্যসময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আরও দৃঢ় করতে জেলা সদরে স্মৃতিস্তম্ভ, উলিপুরের মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চ গড়ে তুলেছিলেন।

কুড়িগ্রামবাসীর কাছে সুলতানা পারভীন অনন্তকালের স্মৃতি হয়েছেন প্রায় চার হাজার মুক্তিযোদ্ধার হাতের ছাপ নিয়ে গড়া ‘বীরগাথা’ নামের ইতিহাসভিত্তিক বইটি প্রকাশ করে, যা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরিদের মাঝে প্রেরণার উৎস হিসেবে জাতীয় আর্কাইভ ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সুরক্ষিত আছে।

এ ছাড়া কুড়িগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে তুলেছিলেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত একটি পুকুর। যেখানে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিনোদনের সময় কাটায়। আর পুকুরের চারপাশে রাস্তাটি হয়ে উঠেছে হাজারো মানুষের শারীরিক যোগব্যায়ামের উপযুক্ত স্থান।

শ্রীরাম কৃষ্ণ আশ্রমের কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক উপাধ্যক্ষ উদয় শঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমে যে কথাটি বলতে হবে, কুড়িগ্রাম জেলায় আজ যে আধুনিকতার ছাপ আমরা দেখতে পাই, তিনি ছিলেন তার রূপকার।

সুলতানা পারভীন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যে কাজটি করেছেন অর্থাৎ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের ছাপ ও স্বাক্ষর নিয়ে যে সংকলন প্রকাশ করেছেন, তার নাম দিয়েছেন ‘বীরগাথা’, সেটি একটি অনন্য উদ্যোগ, যা হাজার বছর ধরে অমর করে রাখবে এই জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের।

তিনি আরও বলেন, সুলতানা পারভীন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার বলিষ্ঠ উদাহরণ। আমি তাকে খুবই শ্রদ্ধা করি বিভিন্ন কাজের জন্য, বিশেষ করে রামকৃষ্ণ আশ্রমের বিভিন্ন সাহায্যের জন্য যখন যেতাম, তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে গ্রহণ করতেন। আমি রামকৃষ্ণ আশ্রমের উদ্যোগে দুবার ওনার আমলে কুমারীপূজা করেছি।

উদয় শঙ্কর চক্রবর্তী বলেন, সেদিন ডিসি এবং এসপি বসে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট দেখেছেন। পরে পূজা শেষ হলে প্রসাদ নিয়েছেন। আমাদের অনুমতি নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করেছেন। ফলে তিনি যখন ফিরে আসেন এবং মন্দির পরিদর্শন করতেন পূজার সময়, সংগত কারণেই এলাকার লোকের কাছে মেসেজ যেত যে অসাম্প্রদায়িক এই জেলা প্রশাসক কোনোভাবেই দেশের সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেবেন না।

তিনি বলেন, আমি মনে করি তার কুড়িগ্রামের মানুষের জন্য যে ভালোবাসা ছিল, বাংলাদেশের যেকোনো জায়গায় যাবেন, সেই ভালোবাসা তার থাকবে। তার ভেতরে বিজ্ঞানের গভীরতা রয়েছে। এটা দিয়ে তিনি দেশকে উন্নত করবেন। তারও সুন্দর একটি অবস্থান হবে। আমি মনে করি সুলতানা পারভীন একজন আদর্শ জেলা প্রশাসক ছিলেন।

কুড়িগ্রাম পৌর শহরের বাসিন্দা ফিরোজ আলম বলেন, কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক তার কার্যক্রমে অল্প সময়ের মধ্যে জনগণের মন জয় করে নেন। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তিনি যে কাজ করেছেন, তাতেই তিনি প্রশংসার দাবি রাখেন। শুধু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নন, আরও অনেক কাজই করেছেন। তবে হঠাৎ সাংবাদিকের সঙ্গে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় এখান থেকে তার চলে যাওয়া একটা দুঃখজনক ঘটনা।

কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন

জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান টিটু বলেন, সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন ছিলেন একজন উন্নয়নকর্মী। কুড়িগ্রাম জেলাকে সাজানোর জন্য খুবই আন্তরিক ছিলেন। এককথায় তিনি একজন উন্নয়নের মানুষ ছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কর্মকাণ্ডকে খুবই ভালোবাসি ও প্রশংসা করি। যা-ই হোক, একটি পরিস্থিতি শিকার হয়েছিলেন তিনি।

যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। ভালো একজন অফিসার ছিলেন। তিনি কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন, তা আর শেষ করে যেতে পারেননি, এটা আমাদের কষ্ট। আমি তার অনেক প্রোগ্রামে ছিলাম। সে সময় দেখেছি জননেত্রী শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুকে খুবই হাইলাইটস করতেন। পরিশেষে বলব সুলতানা পারভীন ভালো একজন জনসেবক ছিলেন।

সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন সম্পর্কে জানতে চাইলে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সিরাজুল ইসলাম টুকু বলেন, আমরা পাকিস্তান শাসনামলে এরশাদুল হক সিএইচপি পাওয়ার পর কুড়িগ্রামে জেলা প্রশাসনে অনেক অফিসার পেয়েছি। অনেকে সুন্দরভাবে কাজও করে গেছেন। তবে সুলতানা পারভীন ছিলেন ব্যতিক্রম।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলতেন, তারা চাইতেও জানে না, দিতেও পারে না। প্রধানমন্ত্রীর এই দৃষ্টির ওপর আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। সেই মুহূর্তে আমরা সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনকে পেয়েছি। তাকে পাওয়ার পর কুড়িগ্রামে উন্নয়নের জোয়ার বয়েছিল। সব সেক্টরসহ গরিব-ধনী সব ধরনের লোকের সঙ্গে ছিল তার মেলবন্ধন। জেলার সঙ্গে উপজেলার যোগাযোগ, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, স্থলবন্দর, কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস চালুসহ নানা সমস্যা ও অভিযোগ প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতেন তিনি।

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বলছি, প্রশাসনে ওই ধরনের দক্ষ লোক আসা উচিত। আমি অনুরোধ করব, সরকার তাকে ক্ষমা করে আবার কুড়িগ্রামে আসার সুযোগ দিলে কুড়িগ্রামের উন্নয়ন কাকে বলে তিনি দেখিয়ে দিতে পারতেন। তিনি অন্যায় করেননি আর অন্যায় করার মতো মানুষও ছিলেন না। কুড়িগ্রামে দেওয়া না গেলে যেখানে দিক, জেলা প্রশাসনে দিক। তাহলে বোঝা যাবে দেশের জন্য তার কতটা আন্তরিকতা ও ভালোবাসা আছে।

কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট আব্রাহাম লিংকন বলেন, আমার মতে তিনি কুড়িগ্রাম জেলার উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। কুড়িগ্রামে যারাই আসেন কিংবা অন্যান্য জেলায় যারাই জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে যান, নির্দিষ্ট রুটিন ওয়ার্কের বাইরে কেউ কিছু করতে চান না। কিন্তু সুলতানা পারভীনের ক্ষেত্রে দেখেছি তিনি রুটিনওয়ার্কের বাইরে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও সাংস্কৃতিক চর্চার জায়গাগুলোয় তিনি যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাজগুলো তার অনন্য। প্রশাসনে ‘লালফিতার দৌরাত্ম্য’ বলে একটা কথা আছে। ডিসি রঙের বিশেষ সাংকেতিক ব্যবহার করে ফাইলপত্র সাজিয়ে রাখার প্রচলন শুরু করেছেন। এতে নাগরিক কাজগুলো সহজ হয়। ফাইল হারানোর শঙ্কা থাকে না।

তিনি আরও বলেন, আমি উদাহরণস্বরূপ বলতে পারি, উলিপুরে শহীদ মিনার রয়েছে, সেটাকে তিনি মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। রৌমারীকে যাতে মুক্তাঞ্চল ঘোষণা করা হয়, সে ব্যাপারে উদ্যোগী করতে সরকারের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন। এ ছাড়া চার হাজার মুক্তিযোদ্ধার হাতের ছাপ নিয়ে ইতিহাসভিত্তিক ’বীরগাথা’ বই তৈরি করেছেন। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনবৃত্তান্ত লেখা রয়েছে। এ ছাড়া জেলার সব পর্যায়ে উন্নয়ন ও অবদান নিয়ে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন, যা এখনো কুড়িগ্রামবাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি।

মো. জুয়েল রানা/এনএ