কিডনিজনিত সমস্যায় শ্বশুরকে নিয়ে এসেছিলাম সদর হাসপাতালে। কিন্তু ডাক্তাররা বলছেন, ‘এখানে কোনো চিকিৎসা হবে না, খুলনা নিয়ে যান। তাই বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছি।’ ২৬ জানুয়ারি আক্ষেপ করে বলছিলেন বাগেরহাট সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের নুসরাত জাহান।

সদর উপজেলার ডেমা থেকে আসা মৌসুমি বেগম নামের অপর এক নারীও জানাচ্ছিলেন একই সমস্যার কথা। তিনি বলেন, ‘প্রসব বেদনা উঠলে ছোটবোনকে এখানে নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু সিজারের জন্য ডাক্তার না থাকায় অন্যত্র নিয়ে যেতে বলছে। আমরা গরিব মানুষ। প্রাইভেট হাসপাতালে আমাদের দেখানোর সাধ্য কি আছে?’

বাগেরহাট সদর হাসপাতালে সার্জারি, গাইনি, চক্ষুসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে চিকিৎসক সংকটের কারণে জেলার ১৮ লক্ষ মানুষকে সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। ফলে খুলনাসহ অন্যত্র চিকিৎসার জন্য যেতে হয় রোগীদের। তবে আর্থিক অসুবিধার কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে চিকিৎসা নেন এই হাসপাতালে। এছাড়া চিকিৎসকদের অবহেলা, শয্যাসংকট ও অবকাঠামোগত বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে রোগী ও স্বজনদের।

এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ১০০ শয্যার এই হাসপাতালটি চলছে ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে। তবে চিকিৎসক সংকট নিরসনে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ডা. জালাল উদ্দিন আহমেদ।

সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা যায়, বাগেরহাট জেলাবাসীর প্রধান চিকিৎসালয় বাগেরহাট সদর হাসপাতাল। ১৯৭০ সালে ৫০ শয্যা নিয়ে বাগেরহাট শহরের মুনিগঞ্জ এলাকায় এই হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয়। ২৭ বছর পরে ১৯৯৭ সালে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয় হাসপাতালটিকে। ১০০ শয্যায় উন্নীত হলেও ২৪ বছর ধরে ৫০ শয্যার জনবল নিয়েই চলছে হাসপাতালের কার্যক্রম।

বর্তমানে ৫০ শয্যার জনবলও অর্ধেকে নেমে এসেছে। গুরুত্বপূর্ণ এই হাসপাতালে কনসালট্যান্টের ১২টি পদের মধ্যে ৭টি এবং মেডিকেল অফিসারের ১২টি পদের ১০টি পদ শূন্য রয়েছে। কনসালটেন্টের শূন্য পদের মধ্যে রয়েছে সিনিয়র কনসালটেন্ট সার্জারি, গাইনি, চক্ষু, অ্যানেস্থেসিয়া, জুনিয়র কনসালটেন্ট অর্থোট্রমেটিক, কার্ডিওলজি, রেডিওলজি। মেডিকেল অফিসারদের মধ্যে ডেন্টাল সার্জন, ইউনানি মেডিকেল অফিসার, মেডিকেল অফিসার, প্যাথলজিস্ট, রেডিওলজিস্টের পদ শূন্য রয়েছে।

এছাড়া একজন নার্সিং সুপারভাইজার, একজন হেলথ এডুকেটর, ২০ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ২ জন কার্ডিওগ্রাফার, ৪ জন সহকারী নার্স এবং একজন অফিস সহায়কের পদ শূন্য রয়েছে। কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসক না থাকায় সেবা না নিয়েই প্রতিদিন অনেক রোগীকে ফিরে যেতে হয়।

রামপালের মল্লিকেরবের ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য লাকি আক্তার বলেন, সরকারি হাসপাতালে বেশির ভাগ গরিব মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। কিন্তু সদর হাসপাতালে আসলেই বলে এই ডাক্তার নেই, ওই ডাক্তার নেই, শুধু নেই আর নেই। রামপালসহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সদর হাসপাতালে আসার পরে যদি বিনা চিকিৎসায় খুলনা বা অন্য কোথাও যেতে হয়, তার চেয়ে কষ্টের কিছু থাকে না আমাদের।

ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ করে চিকিৎসাধীন দেলোয়ার হোসেন নামের এক রোগী বলেন, অনেকজন রোগীর জন্য তিন কক্ষবিশিষ্ট একটি টয়েলেট রয়েছে। তার মধ্যে দুইটি নষ্ট। একটি টয়েলেট পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। অনেক সময় লাইন লেগে যায়। জরুরি ভিত্তিতে এই সমস্যার সমাধান করার দাবি জানান তিনি।

শেখ বেলাল নামের এক রোগী বলেন, কোনো রোগী দুপুর ১২টায় ভর্তি হলে, তাকে পরের দিন সকালে একজন চিকিৎসক দেখেন। এই সময়ে রোগী কষ্টে মরে গেলেও নার্স ছাড়া কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায় না। এই সমস্যার সমাধান হওয়া প্রয়োজন।

বাগেরহাট সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার শেখ আদদান হোসেন বলেন, হাসপাতালে অনেকদিন ধরেই চিকিৎসক সংকট রয়েছে। যার ফলে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে কিছুটা বঞ্চিত। এরপরেও আমাদের যে জনবল রয়েছে, তাই দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার।

বাগেরহাটের সিভিল সার্জন ড. জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, বাগেরহাট সদর হাসপাতালে চিকিৎসক সংকটের বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। ৪২তম বিএসএসের নিয়োগ সম্পন্ন হলে আশা করি এই সংকটের সমাধান হয়ে যাবে।

তানজীম আহমেদ/এমএসআর