মানিকের উপার্জনে চলছে পাঁচজনের সংসার
উচ্চতা মাত্র আড়াই ফুট। জন্মের পর পাড়া-প্রতিবেশীরা আড়চোখে দেখতেন। মা-বাবাকে শুনতে হয়েছে অনেক কথা। লোকে বলত ‘বামন’। মূলত ছোট আকৃতির হওয়ায় আঞ্চলিক শব্দে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে এই নামে ডাকা হতো। মা-বাবাও দুশ্চিন্তায় থাকতেন অস্বাভাবিক আকৃতিতে জন্ম নেওয়া সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। তবে প্রত্যয়ী মা-বাবা হাল ছাড়েননি।
সব সময় উৎসাহ দিতেন। লেখাপড়াও করিয়েছেন ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত। স্কুলের বন্ধুরা কথা বললেও উপহাস করতেন। শেষে আর লেখাপড়া করা হয়নি। মনস্থির করেন সমাজের উপহাসকে উপেক্ষা করে নিজেকে ফেরাবেন স্বাভাবিক জীবনে। এখন তিনি সংসার বা সমাজের বোঝা নন। অন্যের উপার্জনের মুখাপেক্ষী হয়ে নয় বরং নিজের আয়ে চালাচ্ছেন পাঁচজনের সংসার।
বিজ্ঞাপন
বলছিলাম বরিশাল সদর উপজেলার কড়াপুর চৌধুরী বাড়ির ছেলে মানিক চৌধুরীর কথা। তার জীবনের গল্পটা এমনই। তিনি যেমন আকৃতিতে ছোট, তেমনি চাকরিও করেন ছোট। একটি রেস্টুরেন্টের প্রহরী। সকাল ৮টা থেকে রাত পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। রেস্টুরেন্টে পা ফেলতেই তার অভ্যর্থনা ভোজনরসিকদের মন ভরিয়ে দেয়।
অনেকেই কৌতূহলবশত তার সঙ্গে সেলফি তোলেন, আলাপচারিতায় শুনে নেন জীবনের গল্পটাও। মানিক চৌধুরী বলেন, আমি দেখতে ছোট। আল্লাহ এভাবে তৈরি করেছেন। তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি তো কারও কাছ থেকে করুণা নিয়ে চলি না। তাই আমার জীবনে কোনো দুঃখ নেই। আমি সুখী মানুষ।
বিজ্ঞাপন
রেস্টুরেন্ট মালিক মশিউর রহমান বলেন, আড়াই বছর আগে মানিককে আমার রেস্টুরেন্টে নিয়োগ দিই। অনেকেই সং সাজাতে বা মানুষকে চমকিত করতে অস্বাভাবিক আকৃতির ছোট মানুষদের ব্যবহার করে থাকে। দেখা যায়, এই আকৃতির অনেকে পথেঘাটে ভিক্ষা করছেন। কিন্তু মানিক কখনো কারও কাছে হাত পাতেননি। কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে চান। কাজের ক্ষেত্রে মানিক খুবই আন্তরিক। সাধারণ মানুষের মাঝে তার মতো মনোবল ও চেষ্টা থাকলে সমাজ বদলে যেত।
২৩ বছর বয়সী যুবক মানিক চৌধুরী নিজের কর্মসংস্থান করেই ঘর বেঁধেছেন। দুই বছর আগে তিনি ঝালকাঠি সদর উপজেলার বিনয়কাঠি সরকারি কলেজ-সংলগ্ন এলাকায় বিয়ে করেন। স্ত্রী মরিয়ম বেগম। এর আগে ঢাকায় পোশাক তৈরির কারখানায় লিফটম্যান পদে কাজ করতেন।
সাড়ে ৯ মাস আগে ঘর আলো করে মানিক-মরিয়ম দম্পতির ছেলে সন্তান ভূমিষ্ট হয়। মানিক বলেন, আমার স্ত্রী স্বাভাবিক মানুষ। পাঁচ ফুট লম্বা, সুন্দর। তিনি আমাকে ভালোবেসে ‘ছোট ভাই’ বলে ডাকেন।
রেস্টুরেন্টে তিনি অভ্যর্থনা জানানো ও পরিচ্ছন্নতার কাজ করে থাকেন। মাস শেষে যা বেতন পান, তা দিয়েই চলে পাঁচজনের সংসার। স্বপ্ন দেখেন, তার ছেলে মাহাদী লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। দৈহিক কাঠামো যেহেতু ক্ষুদ্রাকৃতির, সেও জানে স্বাভাবিক মানুষের অয়ুষ্কালের সমান তিনি বাঁচবেন না। যে কারণে শেষ বয়সে যেন সামাজিক প্রতিহিংসার শিকার না হতে হয়, সে জন্য সন্তানকে মানুষের মতো মানুষ করতে চান। এ জন্য কারও সাহায্য চান না, চান সহায়তার মনোভাব।
মানিক বলেন, আমার ছেলে বড় হলে যেন কেউ তাকে ‘বামন মানিকের ছেলে’ বলে না ডাকে, সেই অনুরোধ করি।
মানিকের এক সহকর্মী জানান, দীর্ঘদিন তার সাথে কাজ করে আমি নিজের কাজের উৎসাহ ফিরে পাই। তাকে কোনো দিন দুঃখ করতে শুনিনি। অথচ আমাদের অনেক দুঃখ। মূলত তিনি একজন কর্মঠ মানুষ।
রেস্টুরেন্টে আসা সুসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, মানিক চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানাই তার কাজের স্পৃহার জন্য। তিনি অস্বাভাবিক আকার নিয়ে স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে সংসার চালাচ্ছেন।
আরএআর/এসপি