খাদ্য হিসেবে মাংসের বিকল্প কিছুর চাহিদা বাড়ছে, সামনের দিনগুলোতে যা আরও বাড়তে থাকবে। মাংসের বিকল্প হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াতে চাচ্ছে ‘প্ল্যান্ট-বেজড মিট’ বা শস্যভিত্তিক মাংস। তবে বিশ্বের অনেক প্রান্তে  তাকে এখনও বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। 

২০১৯ সালে মাংসের বিকল্প হিসেবে সয়াবিনভিত্তিক একটি খাদ্য প্রথম বাজারে আনার কথা জানা যায় বেয়ন্ড মিট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। গুগল ট্রেন্ডের তথ্য অনুযায়ী ওইসময়েই বিশ্বব্যাপী হঠাৎ করেই প্ল্যান্ট-বেজড মিট লিখে সার্চ করার প্রবণাতা মানুষের বেড়ে যায়। 

বিশ্বব্যাপী মাংসের বিকল্প হিসেবে দাঁড়াতে যাওয়া এই খাতের বর্তমান আকার  ২ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৪ সাল নাগাদ এ খাতের আকার আরও বড় হয়ে দাঁড়াবে ২ হাজার ৩২০ কোটি মার্কিন ডলারের। বাজার নিয়ে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ইউরোমনিটরের কাছ থেকে জেনে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য দিয়েছে সিএনবিসি।  

এ খাতের আকার বৃদ্ধির পালে প্রাণীকল্যাণ থেকে শুরু করে খাদ্য নিরাপত্তা, এমনকি কোভিড-১৯ মহামারির মতো বিষয়গুলো হাওয়া দিচ্ছে।   

দ্য গুড ফুড ইনস্টিটিউট এশিয়া প্যাসিফিকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এলেইন সিউ বলছেন, অস্থিতিশীল এই সময়ে কম ঝুঁকির একটা ভ্যালু চেইন তৈরির অর্থ হলো ভবিষ্যতের সম্ভাবনায় লক্ষ্য স্থির করা।  আর শস্যভিত্তিক মাংসের দিকে ঝোঁক কমার কোনো প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না।  

তারপরও ক্রমবর্ধনশীল এই বাজারের সামনে বহু বাধা রয়েছে।  

এই ডিসেম্বরেই সিঙ্গাপুরের সরকার গবেষণাগারে তৈরি মাংস বিক্রির পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। এই সিদ্ধান্তের পর স্যান ফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক কোম্পানি 'ইট জাস্ট' সিঙ্গাপুরের বাজারে গবেষণাগারে তৈরি মুরগীর মাংস বিক্রি করতে পারবে। গবেষণাগারে তৈরি মাংস বাজারজাত করার ঘটনা বিশ্বে এটাই প্রথম। প্রথম পর্যায়ে চিকেন নাগেট হিসেবে এই মাংস বিক্রি হবে।

সাংস্কৃতিক বাধা
প্রচলিত ধারার কারণে এশিয়ায় শস্যভিত্তিক মাংসের বাজার হয়তো সীমাবদ্ধ থাকবে, বলছেন সিউ। 

উদাহরণ হিসেবে তিনি বলছেন, ‘মক মিট’ বা ‘ভেজিটেরিয়ান মিট,’ যাকে বাংলায় ‘নিরামিষ মাংস’ বলা চলে তা প্রাথমিকভাবে চীনে বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা খেয়েছেন।   

তিনি আরও বলছেন, এসব মাংস স্বাদে-গন্ধে একটা নির্দিষ্ট একটা গণ্ডির বাইরে যেতে পারেনি। এরসঙ্গে তিনি যুক্ত করেন, আসলে ঐতিহ্যবাহী এসব খাবারের নির্দিষ্ট একটা উদ্দেশ্য থাকে আর এর আবেদনটাও অনেকের কাছে নির্দিষ্ট। 

তাই শস্যভিত্তিক মাংস এশিয়ায় তার সম্ভাব্য পুরো বাজারটা ধরতে চাইলে একে প্রচলিত ‘নিরামিষ মাংসে’র বলয় থেকে বের হতেই হবে। 

প্রচলিত মাংসের বাজার থেকে আপত্তি
আমেরিকান ব্যাংক জেফেরিজের থিমেটিক রিসার্চের গ্লোবাল হেড সাইমন পাওয়েল বলছেন, বিকল্প এই প্রোটিন খাতের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন খামারিরা। যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ করে এটা বেশি ঘটতে পারে। 

যুক্তরাষ্ট্রের পশুখামারিদের জোট দ্য ইউএস ক্যাটেলমেন'স অ্যাসোসিয়েশন ২০১৮ সালে বিফ ও মিটের আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা চেয়ে কোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শস্যভিত্তিক মাংসকে এ সংজ্ঞার বাইরে রাখা। 

বিজ্ঞাপনে এটাকে যেন মাংস না বলা যায়, সরকারকে চাপে ফেলে তার একটা চেষ্টাও চলছে; যেটাকে বিকল্প এই মাংসের জন্য একটা বড় বাধা বলে মনে করা হয়।  

বিকল্প মাংসের কথা বলতে গিয়ে রেস্তোরাঁ ও দোকানে সসেজ ও বার্গার ব্যবহার গেল অক্টোবরে নিষিদ্ধ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। 

‘মক মিট’ কী? কিভাবে এলো
এক কথায় উদ্ভিজ মাংসটি শুরুর দিকে ভেজিটেরিয়ানদের কথা ভেবেই তৈরি হয়েছিল। ভেজিটেরিয়ানরা মনে করেন, চিকেন বা মাটন খাওয়া কমালে বাণিজ্যিক খামার কমবে। ফলে চারণভূমি বাড়ানোর জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা, রেইন ফরেস্ট ধ্বংস বন্ধ হবে। মুরগি, ছাগল, গরু, ভেড়ার মতো গবাদি পশুদের আটকে রেখে হরমোন ইঞ্জেকশন দেওয়াও কমবে। কিন্তু এখন ভেগানদের হাত ঘুরে তা চিকেন-মাটন ভক্তদের প্লেটেও পৌঁছেছে। আর স্বাস্থ্যের গুণাগুণ বুঝে অনেক নন-ভেগানও এখন ‘মক মিটে’র দিকে ঝুঁকছেন। 

ক্রেতার আস্থা, ক্রেতার দ্বিধা
পাওয়েল আরও বলেন, শস্যভিত্তিক মাংস উৎপাদনকারী কোনো কোম্পানি যদি কোনো ধরনের দুর্ঘটনার কারণে অথবা তাদের রেসিপিতে কোনো সমস্যার কারণে একবার তাদের সমস্ত পণ্য বাজার থেকে তুলে নেয়ার ঘোষণা দেয়, তাহলে ক্রেতারা এই পণ্য খাওয়ার বিষয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে যাবে।  

তিনি বলছেন, এটা আসলে অনেক বড় একটা ‌‌‘যদি’। তবে কোনো না কোনো সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটবেই। আর তখন এ খাত একটু ধাক্কা খাবে।  

পাওয়েল আরও বলছেন, শস্যভিত্তিক খাদ্যের ‘ইনস্টাগ্রামাবিলিটি’ (কোনো বিষয় বা ইস্যু যা নিয়ে মানুষজন ইনস্টগ্রামে ছবি পোস্ট করছে) একটি বিষয়, যার কারণে বিশ্বের সব জায়গাতেই এই শস্যভিত্তিক মাংসের বাজার বড় হচ্ছে। তবে এই বাজারের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে যদি এর নতুনত্বের বিষয়টি হারিয়ে যায় বা চাপা পড়ে যায়।  

সূত্র : সিএনবিসি।  

এনএফ