কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, দেশের ডলারের বাজার এখন অনেকটাই স্থিতিশীল। এমন প্রেক্ষাপটে ডলারের বিনিময় হার এখন থেকে বাজারভিত্তিকভাবে নির্ধারিত হবে—অর্থাৎ, ডলারের মূল্য এখন ঠিক করবে বাজার নিজেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণ করত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত হিসেবে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এই সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয় ঊর্ধ্বমুখী থাকায় এবং বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানি ও অন্যান্য পণ্যের দাম কমার প্রেক্ষাপটে এই পদক্ষেপ এখন গ্রহণযোগ্য।

তবে তারা সতর্ক করে বলেছেন, এই ‘বাজারভিত্তিক ব্যবস্থা’ যেন অশুভ চক্রের খেলার মাঠে পরিণত না হয়। কেউ যাতে কৃত্রিমভাবে বাজারকে অস্থির করতে না পারে, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।

ডলারের দাম বাজারভিত্তিক করা নিয়ে আইএমএফের সঙ্গে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের দর–কষাকষি চলছিল। মূলত সে কারণে আইএমএফ ঋণের কিস্তি আটকে ছিল। এর মধ্যে মঙ্গলবার জানা যায়, বিনিময় হারে নমনীয় করতে রাজি হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যার পরিপ্রেক্ষিতে চলমান ৪৭০ কোটি ডলারে ঋণের দুটি কিস্তি একসঙ্গে ছাড় করতে রাজি হয়েছে আইএমএফ। এরপর বুধবার গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ডলারের বিনিময় হার এখন থেকে ‘বাজার’ ঠিক করবে।

সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর বলেন, ডলারের বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার এখন ভালো সময়। তার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এখন প্রবাসী আয় ভালো আসছে, রিজার্ভও স্থিতিশীল, উন্নতি হয়েছে লেনদেন ভারসাম্যের। আগামী জুন মাসের মধ্যে ৩৫০ কোটি ডলার আসবে। এতে রিজার্ভ আরও বাড়বে। ফলে বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার এটাই ভালো সময়।’

বাজারভি‌ত্তিক করায় হঠাৎ রেট অনেক বেড়ে যাবে না এমন আশ্বাস দিয়ে গভর্নর জানান, ডলার রেট অনেক দিন এক জায়গায় অর্থাৎ ১২২ টাকায় আছে। তার আশপাশেই থাকবে। হঠাৎ ক‌রে ১৪০-১৫০ হবে এটার যুক্তি নেই। বাংলাদেশের ডলার রেট এদেশের নিয়ম অনুযায়ী ঠিক হবে, অন্য দেশের কথায় এখানে ডলার রেট ঠিক হবে না। বাজারে ডলারের যথেষ্ট সরবরাহ আছে।

কেউ কেউ বাজার অস্থি‌তি‌শীল করার চেষ্টা করবে এমন শঙ্কা ক‌রে গভর্নর জানান, কিছু সিন্ডিকেট কোম্পা‌নি আছে যারা বাজার অস্থি‌তি‌শীল করার চেষ্টা কর‌বে। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স‌চেতন থাক‌বে এবং সার্বক্ষণিক তদার‌কি করা হ‌বে। য‌দি কেউ অ‌নৈ‌তিক উপায়ে অ‌স্থি‌তিশীল করার চেষ্টা ক‌রে তা‌দের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হ‌বে। এছাড়া এখনকার দামের সঙ্গে যেন খুব বেশি পার্থক্য না হয়, সেদিকে নজর রাখতে বলা হয়েছে— জানান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।

বিনিময় হার বাজারভিত্তিক নিয়ে যা বলছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা

বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ডলারের বাজার এখন স্থিতিশীল। বাজারভিত্তিক ব্যবস্থার দিকে যাওয়াটা সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে এখন সবাইকে নিজেদের জায়গা থেকে দায়িত্বশীল হতে হবে। কেউ যদি সুযোগ নিয়ে ডলারের বাজারে কৃত্রিম চাপ তৈরির চেষ্টা করে, সেটা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে। তাই অশুভ চক্রকে খেলার সুযোগ দেওয়া যাবে না। কেউ যদি এই সুযোগে ডলারের বাজার নিয়ে খেলার চেষ্টা করে, সেটা মোটেও ঠিক হবে না। আমরা আশাবাদী এমনটা হবে না—বাজার স্থিতিশীল থাকবে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিনিময় হার আরও নমনীয় করে আইএমএফের ঋণের কিস্তি ছাড় হলে তা দেশের জন্য ইতিবাচক হবে। এর মাধ্যমে বড় ধরনের ঝুঁকি কেটে গেছে। কারণ, আইএমএফের ঋণ ঝুলে গেলে অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর ঋণও আটকে যেতে পারত। বিনিময় হার নমনীয় করার জন্য এখনই উপযুক্ত সময়। রপ্তানি ও প্রবাসী আয় বাড়তির দিকে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেল, গ্যাস ও কয়লাসহ নানা পণ্যের দাম ১২ শতাংশ কমার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। তাই এই মুহূর্তটাই সবচেয়ে উপযোগী।

ড. জাহিদ আরও বলেন, ডলারের দাম পুরোপুরি বাজারভিত্তিক কোনো দেশই নির্ধারণ করে না। তবে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তা ঠিক করা হয়। বাংলাদেশেও তেমনটাই করতে হবে। তবে ভয় দেখিয়ে নয়, বরং ডলারের লেনদেনের মাধ্যমে বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হবে। এটাই এখনকার বৈশ্বিক রীতি। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে ‘ক্রলিং পেগ’ নামে একটি নতুন বিনিময় হার পদ্ধতিতে দর নির্ধারণ করে। এই পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রা বেচা-কেনায় আড়াই শতাংশ হারে বাড়ানো বা কমানো যায়। ক্রলিং পেগে বর্তমানে মধ্যবর্তী দর ১ ডলারের দাম ১১৯ টাকা। এর সঙ্গে বিদ্যমান আড়াই শতাংশের পরিবর্তে সর্বোচ্চ চার শতাংশ করিডর দেওয়া হতে পারে। এতে করে যদি বাড়ে তাহলে সর্বোচ্চ এক থেকে ২ টাকা বাড়বে। তবে বর্তমান বিশ্ব বাজার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে বাড়ার সম্ভাবনা কম।  

আইএমএফের স্টাফ-লেভেল চুক্তি চূড়ান্ত :

বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেওয়ার পরই সন্ধ্যায় আইএমএফ-বাংলাদেশের মধ্যে সম্প্রতি ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ ছাড়ের বিষয়ে একটি স্টাফ-লেভেল চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে বলে আইএমএফ এর পক্ষ থেকে জানানো হয়। সংস্থাটি জানায়, এই অর্থ ছাড় হলে ইসিএফ, ইএএফ ও আরএসএফ মিলিয়ে আইএমএফ-এর মোট ঋণ সহায়তা দাঁড়াবে ৫.৪ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফ-এর নির্বাহী বোর্ডের অনুমোদনের পর এই অর্থ ছাড় হবে জুনে।  

আইএমএফ জানিয়েছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধে দেশের অর্থনীতি নানা চাপের মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩.৩ শতাংশে। যদিও অর্থবছরের শেষে তা কিছুটা বেড়ে ৩.৮ শতাংশে পৌঁছাতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি। অপরদিকে, উচ্চ মূল্যস্ফীতিও এখনো বড় একটি চ্যালেঞ্জ। সংস্থাটির পূর্বাভাস, বছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৮.৫ শতাংশে নেমে আসতে পারে।

এই পরিস্থিতিতে আইএমএফ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় কমানো, মুদ্রানীতিতে কঠোরতা বজায় রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ব্যাংক খাতের দুর্বলতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে সংস্থাটি। তাদের মতে, এই খাতের স্থিতিশীলতা আনতে একটি সমন্বিত ও কাঠামোগত রূপরেখা জরুরি।

এই রূপরেখার আওতায় দুর্বল ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠনের আইন দ্রুত বাস্তবায়ন, বড় ব্যাংকগুলোর সম্পদের মান যাচাই এবং ঝুঁকিনির্ভর তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর ওপরও গুরুত্ব দিয়েছে আইএমএফ, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালীভাবে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন ও আর্থিক খাত তদারকিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

এদিকে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবেশ উন্নয়ন ও বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের ওপরও জোর দিয়েছে আইএমএফ। তারা বলেছে, সুশাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। তৈরি পোশাকের বাইরে অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, টেকসই অবকাঠামো এবং দায়িত্বশীল ব্যয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

আইএমএফ-এর বাংলাদেশ মিশনপ্রধান পেট্রোস পাপাগিওর্জিও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার সংস্কার কার্যক্রমে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং তারা অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন, তা প্রশংসনীয়।’

জুনের মধ্যে আসবে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার

আইএমএফের স্ট্যাফ লেভেল সমঝোতা হওয়ায় আগামী জুনের মধ্যে আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা থেকে সা‌ড়ে তিন বি‌লিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা পাবে বাংলা‌দেশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, আইএমএফ দেবে ১৩০ কোটি ডলার। বাকি ২২০ কোটি ডলার আসবে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, এআইআইবি ও ওপেক থেকে।

এসআই/এমএ