সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে কলম বিরতির আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করেছে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ। একই সঙ্গে আগামীকাল ২০ মে (মঙ্গলবার) বিকেল সাড়ে তিনটার আলোচনা অংশ নিতে যাচ্ছে ঐক্য পরিষদের ১৫ থেকে ২০ জনের প্রতিনিধি দল।

সোমবার (১৯ মে) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআরের নিচে সংবাদ সম্মেলনে ঐক্য পরিষদের কর্মকর্তারা এমন ঘোষণা দিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনায় সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনার প্রস্তাব পেয়েছি। আগামীকাল (মঙ্গলবার) বিকেল সাড়ে ৩টায় আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। অর্থ উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টামণ্ডলীর কয়েকজন সম্মানিত সদস্য এতে অংশগ্রহণ করবেন বলে আমরা জেনেছি। আমরা বরাবরই বলেছি, আমরা আলোচনার জন্য প্রস্তুত এবং আমাদের একটি প্রতিনিধিদল সে আলোচনায় অংশগ্রহণ করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই আলোচনার আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের কর্মসূচি আগামীকাল সাময়িক বিরতি থাকবে এবং আগামীকালের আলোচনার অগ্রগতির ভিত্তিতে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

তারা বলেন, আমাদের দাবিসমূহ আমরা পুনর্ব্যক্ত করছি। যার মধ্যে রয়েছে- জারিকৃত অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে; রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ জনসাধারণের জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে এবং এনবিআর কর্তৃক প্রস্তাবিত খসড়া এবং পরামর্শক কমিটির সুপারিশ আলোচনা-পর্যালোচনাপূর্বক প্রত্যাশী সংস্থাসমূহ, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃত্বসহ সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মতামত নিয়ে উপযুক্ত ও টেকসই রাজস্ব প্রশাসন সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।

আজকের সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের পক্ষ থেকে উপকমিশনার ইমাম গাজ্জালী বলেন, এই আন্দোলনকে বিভিন্নভাবে ট্যাগিং দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এই আন্দোলন পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসরদের সৃষ্টি—এই ধরনের গুজব ছড়ানোর অপচেষ্টাও আমরা দেখছি। এই আন্দোলনকে নস্যাৎ করার এমন বানোয়াট ও অসত্য প্রচারণা আপনারা বিগত কয়েকদিনে প্রত্যক্ষ করেছেন। আমরা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলতে চাই, এই আন্দোলন সবার, সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীর। এই আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্ত। এ ধরনের মিথ্যা ট্যাগিং দিয়ে বা গুজব ছড়িয়ে এই যৌক্তিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করা যাবে না। বরং এই ধরনের মিথ্যাচার আন্দোলনকে আরও বেগবান করবে। যারা অসত্য ও বিকৃত তথ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলকে বিভ্রান্ত করছেন, সময়ই বলে দিবে তাদের এই অপপ্রচার কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এই সমাজ ও রাষ্ট্রকে।

ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে উপকর কমিশনার সাইফুর রহমান বলেন, দেশের স্বার্থে রাজস্ব ব্যবস্থার যুগোপযোগী ও টেকসই সংস্কার কেবল এনবিআরের সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবি নয়; বরং করদাতা সমাজ, ব্যবসায়ী সমাজ, সিভিল সোসাইটিসহ সব অংশীজনের দাবি। গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের মতামত গ্রহণ না করে, সরকার কর্তৃক গঠিত সংস্কার কমিটির সুপারিশ প্রকাশ না করে এবং তা আলোচনা-পর্যালোচনার সুযোগ না দিয়ে, সবাইকে অন্ধকারে রেখে নজিরবিহীন দ্রুততা ও গোপনীয়তার সাথে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। অংশীজনদের মতামত গ্রহণ না করে একতরফাভাবে গৃহীত এই সংস্কারের উদ্দেশ্য ও কার্যকারিতা নিয়ে ইতোমধ্যে রাজনৈতিক নেতারা, ব্যবসায়ী মহল, পলিসি থিংক-ট্যাংকসহ বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলেছেন।

তিনি আরও বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই রাজস্ব ব্যবস্থা সংস্কারের নামে একশ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান এনবিআরকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে দেশের রাজস্ব এজেন্সিকে সংস্কারের মাধ্যমে শক্তিশালী করা প্রয়োজন, সেখানে এটিকে বিলুপ্ত করে রাজস্ব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে দুটি বিভাগ সৃষ্টি করা হচ্ছে; যা রাজস্ব ব্যবস্থাপনার আন্তর্জাতিক রীতিনীতির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এনবিআর বিলুপ্ত নয় বরং এনবিআরকে স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী এজেন্সি হিসেবে রেখেই রাজস্ব সংস্কার করতে হবে। আমরা সবসময়ই বলে আসছি যে, আমরা সবাই সংস্কারের পক্ষে। রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনার পৃথকীকরণ রাজস্ব ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের জন্য আমরা বদ্ধপরিকর। আমরা বলছি, এই সংস্কার হতে হবে বাস্তবমুখী, অংশীজনের মতামতভিত্তিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার সর্বোচ্চ মূল্যায়নের মাধ্যমে।

সংবাদ সম্মেলনে করদাতা ও সেবাপ্রার্থীদের এই আন্দোলনের ফলে সাময়িক অসুবিধার জন্য ঐক্য পরিষদ আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করেছে।

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ মনে করে, তাদের এই সাময়িক ত্যাগ দেশ ও জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এবং রাজস্ব ব্যবস্থার টেকসই সংস্কারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি, তারা এটাও জানিয়ে রাখতে চান, তাদের দাবি আদায় হলে তারা নির্ধারিত অফিস সময়ের বাইরে অতিরিক্ত সময়ে কাজ করে অনিষ্পন্ন কার্যক্রম সম্পন্ন করবেন। এই দাবির যৌক্তিকতার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরায় ফেডারেশন অব বাংলাদেশ কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস এসোসিয়েশন, অ্যাসোসিয়েশন অব রিটায়ার্ড বিসিএস অফিসার্স অব কাস্টমস অ্যান্ড ভ্যাটসহ (আরবোকাভ) সব স্টেকহোল্ডারদেরকে ধন্যবাদ জানানো হয়।

এদিকে আজ (সোমবার) সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টা এনবিআর ও এনবিআরের অধীন কাস্টম হাউস, শুল্ক স্টেশন, ভ্যাট কমিশনারেট ও কর অঞ্চলগুলো কলম বিরতি পালন করে।

পরামর্শক কমিটির সুপারিশ এড়িয়ে ও স্টেকহোল্ডারসহ আমাদের মতামতকে উপেক্ষা করে ১২ মে রাতে গোপনীয়ভাবে অধ্যাদেশটি জারি করা হয়েছে। খসড়া অধ্যাদেশ জারির পর থেকেই আন্দোলন শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত ১৩ মে আগারগাঁও এনবিআরের সামনে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই কলম বিরতির ঘোষণা দেন। এরপর ১৪, ১৫, ১৭ ও ১৮ মে কলম বিরতি কর্মসূচী পালন করা হয়।

আরএম/এমজে