মোবাইল আর্থিক সেবার খরচ ব্যাংকের তুলনায় ৭-১৫ গুণ
বাংলাদেশে মোবাইল আর্থিক সেবা পেতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের থেকে প্রায় ৭-১৫ গুণ বেশি সেবামূল্য পরিশোধ করতে হয় গ্রাহককে। প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ।
মঙ্গলবার (২৭ মে) ধানমন্ডির নিজ কার্যালয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য উঠে আসে।
বিজ্ঞাপন
আজ ‘মোবাইল আর্থিক সেবাখাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বক্তব্য রাখেন।
টিআইবির গবেষণা বলছে, মোবাইল আর্থিক সেবা (এমএফএস) খাতে গ্রাহকদের সেবা পেতে বাণিজ্যিক ব্যাংকের থেকে প্রায় ৭ থেকে ১৫ গুণ (৬.৯-১৫.৯ গুণ) বেশি সেবামূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। ২০২৪ সালে ৫.৫ লাখ কোটি টাকা ‘ক্যাশ আউটের’ ক্ষেত্রে গ্রাহকদের থেকে প্রাক্কলিতভাবে কমপক্ষে ৪ হাজার ৪১০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা পর্যন্ত সেবামূল্য আদায় করা হয়েছে, যেখানে সমপরিমাণ নগদ উত্তোলনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সেবামূল্য আদায় করেছে মাত্র ৬৩৯ কোটি টাকা। এমনকি প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে এমএফএস সেবামূল্য সর্বোচ্চ। সেবামূল্য তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে (বিকাশ) ২৫ হাজার টাকা নগদ উত্তোলনে ৩৭২.৫ থেকে ৪৬২.৫ টাকা আদায় করা হয়, যেখানে সমপরিমাণ টাকা উত্তোলনে পাকিস্তানে ৩৫৫.৭ টাকা এবং মিয়ানমারে ২৩১.৩ টাকা সেবামূল্য হিসেবে আদায় করা হয়। ভারতে এ ধরনের সেবার ক্ষেত্রে কোনো সেবামূল্য আদায় করা হয় না।
বিজ্ঞাপন
গবেষণায় আরও দেখা যায়, এমএফএস খাতে গ্রাহক স্বার্থ অনেকাংশে উপেক্ষিত হয়েছে এবং পাশাপাশি প্রতারণার হার আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। পূর্ণাঙ্গ আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি, প্রতিষ্ঠানভেদে বৈষম্যমূলক মডেল ও শর্তারোপ, সেবামূল্য নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপের সুযোগ না থাকা এবং বিদ্যমান আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে এমএফএস খাতে একচেটিয়া বাজার তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে বিকাশ ও নগদ বাজারের সিংহভাগ (ব্যক্তিগত হিসাবধারীদের ৮৪.৪ শতাংশ বিকাশ, ৩০.৯ শতাংশ নগদ) নিয়ন্ত্রণ করছে।
গবেষণায় দেখা যায়, এমএফএস খাতের উন্নয়ন ও বিকাশে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এ খাতে ‘অ্যাডহক’ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা, নীতি দুর্বলতা, বিদ্যমান আইনের ঘাটতি এবং রাজনৈতিক ও স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব লক্ষ করা গেছে। এমএফএসপির উদ্যোক্তা, নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কর্তৃপক্ষ এবং রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের একটি অংশ ত্রিপক্ষীয় আঁতাতের মাধ্যমে নীতি করায়ত্ত, তদারকি ব্যবস্থাকে প্রভাবিত এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে এমএফএস খাতকে কুক্ষিগত করেছে। এমএফএস খাতকে করায়ত্ত করা এবং বিদ্যমান সুশাসনের ঘাটতির ফলে এই খাতে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সংকুচিত এবং এ খাতের সুষ্ঠু বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এমএফএস খাত করায়ত্ত করার জন্য রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় নীতিকাঠামো ও আইনি দুর্বলতার অপব্যবহার করা হয়েছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ করে নগদকে অনৈতিক সুযোগ দেওয়ার এবং তার মাধ্যমে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধা অর্জনের জন্য এ গুরুত্বপূর্ণ খাতের উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র বিনষ্ট করা হয়েছে। আবার নীতিকাঠামোর দুর্বলতার কারণে এ খাতে আমরা একদিকে যেমন একটি প্রতিষ্ঠানে একচেটিয়া বাজার দেখছি অন্যদিকে নারী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির নামে এ অন্তর্ভুক্তি সুফল থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সেবামূল্য নির্ধারণের এখতিয়ার এককভাবে এমএফএসপির হাতে ন্যস্ত থাকায় স্বাভাবিক ব্যাংকিং খাতের তুলনায় অনেক বেশি সেবামূল্য দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের, যার বোঝা বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী এবং অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিতদের তুলনামূলক বেশি বইতে হচ্ছে। সেবামূল্যের এই উচ্চ হার, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডেও অস্বাভাবিক, এ বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্য আমরা কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই। গ্রাহকের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা ও আইনি কাঠামোর মাধ্যমে পুরো খাতকে ঢেলে সাজাতে হবে।
ঘুষ, অর্থপাচার, অনলাইন জুয়া, ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনে এমএফএস ব্যবহার দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমাদের বৈদেশিক রেমিট্যান্সের যে রেকর্ড বৃদ্ধি হয়েছে তার অন্যতম কারণ এমএফএস ব্যবহার করে অবৈধ হুন্ডি লেনদেন নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। যদিও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার কারণে নয়, এ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে এমএফএস ব্যবহার করে অর্থপাচারে জড়িত অপশক্তির পতনের ফলে। এ দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এই পরিবর্তনকে স্থায়িত্ব দিতে উদ্যোগী হবে বলে আমরা আশা করি। পাশাপাশি, আগে যে সরাসরি ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা ছিল, এখন তা এমএফএস-এর মাধ্যমে করার সুযোগ হয়েছে। তাই এমএফএস খাতকে আয়করের আওতায় আনতে হবে। এর ফলে বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ আয়, কর ফাঁকি এবং ঘুষ লেনদেনের বিষয়সমূহ চিহ্নিত করা যাবে।
গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলের আলোকে টিআইবির ১৩ দফা সুপারিশের মধ্যে রয়েছে- এমএফএস খাতের জন্য স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন করা, যেখানে সবার জন্য সমান প্রতিযোগিতা, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিসহ সুশাসন নিশ্চিত কল্পে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের ভূমিকা সুনির্দিষ্ট করা, আন্তর্জাতিক উত্তম চর্চার আলোকে এমএফএস পরিচালন ও ব্যবস্থাপনা কাঠামো নিশ্চিত করা, সেবামূল্য এবং এজেন্ট ও পরিবেশকদের কমিশনের সীমা নির্ধারণ এবং এর তদারকি নিশ্চিত করা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯ সংশোধন করে বিএফআইইউর গোয়েন্দা প্রতিবেদন সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে আদালতে উপস্থাপনের বিধান করা, গ্রাহক স্বার্থ বিবেচনা করে সেবামূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমানো এবং সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আন্তঃলেনদেন ব্যবস্থা সহজ ও সাশ্রয়ী করা, এমএফএস খাতে সংঘটিত সব অনিয়ম ও দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নির্বিশেষে অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
আরও পড়ুন
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান।
প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ ফেলো মোহাম্মদ নূরে আলম এবং রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কাজী আমিনুল হাসান। টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনটি সঞ্চালনা করেন।
আরএম/এমএন