বাংলাদেশের শিল্প ও আর্থিক খাতে বড় অগ্রগতি হিসেবে দেশবন্ধু গ্রুপ প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ বিদেশি বিনিয়োগ আনতে যাচ্ছে। যার মাধ্যমে গ্রুপটি ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠনও করবে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা সাড়ে চার হাজার কোটি টাকারও বেশি। সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) এই এফডিআই জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

প্রথম পর্যায়ের এই বিনিয়োগ আসছে বিশ্ব বিখ্যাত বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বেকার টিলি জেএফসি গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় আমেরিকার বিনিয়োগকারীদের পক্ষ থেকে। বিটি জেএফসি গ্রুপ ইতোমধ্যে দেশবন্ধু গ্রুপের সঙ্গে যৌথ চুক্তির আওতায় এক বিলিয়ন ইউরোর বেশি দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই অর্থায়নের প্রথম ধাপে দেশের বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়ান-টাইম এক্সিট পলিসি অনুযায়ী (বিআরপিডি সার্কুলার নং ১৩, ৮ জুলাই ২০২৪) দেশবন্ধু গ্রুপের ঋণ পুনর্গঠন করা হবে। চুক্তির আওতায়, বেকার টিলি জেএফসি গ্রুপ সুদ ও জরিমানা বাদে কেবল বিদ্যমান ঋণগুলোই ছাড়প্রাপ্ত মূলধনের ভিত্তিতে পরিশোধের ব্যবস্থা করবে। 

এই পদক্ষেপ দেশবন্ধু গ্রুপের ওপর বিদ্যমান উচ্চ সুদের বোঝা হ্রাস করবে। বিটি জেএফসি গ্রুপের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের শীর্ষ সারির শিল্পপ্রতিষ্ঠান দেশবন্ধু গ্রুপের শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে। ফলে বেকার টিলি জেএফসি গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় এই বিনিয়োগ দেশবন্ধু গ্রুপের সক্ষমতাকে আরও বাড়াবে এবং বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী ঋণের পরিমাণ (মূলধন ও সুদ আলাদা করে) যাচাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এ ব্যাপারে গত ১৬ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর একটি চিঠি পাঠিয়েছে বিশ্ব বিখ্যাত বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বেকার টিলি জেএফসি গ্রুপ। চিঠিতে বেকার টিলি জেএফসি গ্রুপ বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরের কাছে অনুরোধ করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত দেশবন্ধু গ্রুপের মূল ঋণ এবং সুদের পরিমাণ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। যাতে তারা ঋণ অধিগ্রহণ শুরু করতে পারেন।

তিনি আরও বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিএফও এম এ বশির আহমেদ চুক্তির প্রক্রিয়া তদারকি করবেন। এই উদ্যোগ সফল হলে এটি বাংলাদেশে ঋণ পুনর্গঠন এবং শিল্পখাতে এফডিআই আনার ক্ষেত্রে এক মাইলফলক হয়ে থাকবে। 

এদিকে এফডিআইয়ের মাধ্যমে দেশবন্ধু গ্রুপ ঠিক এমন সময় দেশে বড় বিনিয়োগ আনছে, যখন জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়ন সংস্থা (ইউএনসিটিএডি) বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহ কমার খবর দিয়েছে।

সম্প্রতি সংস্থাটির ‘ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৫’ এ বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে এফডিআই প্রবাহ ১৩ শতাংশের মতো কমেছে, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য উদ্বেগের বিষয় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। গত ১৯ জুন প্রকাশিত রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশে প্রকৃত বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ এসেছে মাত্র ১২৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, এফডিআইয়ের এই পতন অর্থনীতির জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই বিনিয়োগের পতনের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, বিনিয়োগ পরিবেশের অপ্রতুলতা এবং বৈদেশিক মুদ্রার অনিশ্চয়তা অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন দিক থেকে উদ্ভূত বৈশ্বিক অস্থিরতা ও বাণিজ্যযুদ্ধও এফডিআই প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ঠিক সেই সময় দেশবন্ধু গ্রুপ একাই প্রথম পর্যায়ে ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি এফডিআই আনছে দেশে। যা দেশের জন্য সত্যিই সুখবর। 

এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশবন্ধু গ্রুপ দেশের শিল্প-প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতির স্বার্থে বিদেশ থেকে যে বিনিয়োগ আনছে তা সত্যি দেশের জন্য বড় ধরনের সাপোর্ট। তাদের মতো দেশের বড় বড় শিল্পগ্রুপকে বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে বিদেশি বিনিয়োগের স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের নীতি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নয়ন জরুরি। পাশাপাশি, সরকারের কর ব্যবস্থা, প্রণোদনা এবং বিনিয়োগকারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করাও অপরিহার্য। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) এফডিআই প্রবাহ কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ। এ অবস্থায় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কেবল করছাড় বা সম্মেলন আয়োজন যথেষ্ট নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিশ্বাসযোগ্য নীতিকাঠামো নিশ্চিত করা জরুরি। 

এ বিষয়ে ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) প্রেসিডেন্ট এবং ইউনিলিভার বাংলাদেশের চেয়ারম্যান জাভেদ আখতার বলেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিবেশ কখনোই খুব একটা সহায়ক ছিল না। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। তার মতে, সরকারের সাম্প্রতিক কিছু সংস্কার কার্যক্রম ইতিবাচক হলেও বিনিয়োগ পরিবেশে দৃশ্যমান পরিবর্তন আনতে সময় লাগবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনের শাসন ফিরিয়ে এনে ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশ দিলে অনেক ব্যবসায়ীরা বিদেশি বিনিয়োগে ঝুঁকবে। 

জাভেদ আখতার বলেন, দেশবন্ধু গ্রুপ শুরু করেছে। তারা সফলতা পেলে আরও অনেকেই এগিয়ে আসবে। 

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও রিভারস্টোন ক্যাপিটাল লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) আশরাফ আহমেদ বলেন, এক কথায় বলতে গেলে, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নেই। দেশি-বিদেশি সব বিনিয়োগই কমছে। দ্রুত এ অবস্থার পরিবর্তন করা দরকার। দেশবন্ধু গ্রুপ বিদেশি যে বিনিয়োগ আনছে তা দেশের এই ক্রাইসিস মুহূর্তে বড় কাজে দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিডার উচিত হবে বিদেশি বিনিয়োগ টানতে ব্যবসায়ীদের সার্বিক সহায়তা করা। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী বলেন, দেশে বিনিয়োগ টানতে সরকার নতুন করে কিছু করছাড়ের সুবিধা দিয়েছে। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রেও করছাড়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগে গতি আনতে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদকে আহ্বায়ক করা হয়েছে।

এমএ