ফাইল ছবি

দেশের প্রথম পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা এবং বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র (বিসিএফসিসি) পরিচালনার মাধ্যমে ব্যবসা করে রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানি বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড। ভ্রমণ ও আবাসন খাতের এই কোম্পানিটি দীর্ঘ বছর ধরে লোকসানের বেড়াজালে আটকে আছে। বড় অঙ্কের পুঞ্জীভূত লোকসানের পাশাপাশি কোম্পানির চলতি মূলধনেও বড় অঙ্কের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাছাড়া রিজার্ভে ঘাটতি পড়েছে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বেশি। অথচ ব্যবসা পরিচালনায় আরও প্রায় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এমন দুর্বল পারফরম্যান্সের কারণে কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে নিরীক্ষক।

নিরীক্ষকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন সমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ সার্ভিসেস-এর পুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ৭০৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এ সময় পর্যন্ত কোম্পানির চলতি মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩০৮ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। আর বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯০৭ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আর ঋণ ইক্যুইটি রেশিও দাঁড়িয়েছে ০.৪২। এসব কারণে কোম্পানিটি ভবিষ্যতে তার কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

এদিকে, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, কোম্পানির রিজার্ভ ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ৭৩৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।

আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা ও বিসিএফসিসি পরিচালনায় দীর্ঘ বছর ধরে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। এতে প্রায় এক যুগ ধরে কোম্পানির লোকসান হচ্ছে। ১৯৮৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া কোম্পানিটি সর্বশেষ মুনাফা করেছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে, যার পরিমাণ ছিল মাত্র ৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। পরের অর্থবছরে কোম্পানির নিট লোকসান হয়েছিল ৩০ কোটি ৭৯ লাখ টাকা।

এরপর ধারাবাহিকভাবে প্রতি অর্থবছরে লোকসান হয়েছে কোম্পানির। ২০১৩-১৪ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত কোম্পানির যথাক্রমে– ১৯ কোটি ৫ লাখ, ৪৯ কোটি ২৮ লাখ, ৫৫ কোটি ৪৫ লাখ, ৩৬ কোটি ৪৪ লাখ, ৪৬ কোটি ৩০ লাখ, ১৮০ কোটি ৬৬ লাখ, ১১০ কোটি ৯৬ লাখ, ৮৫ কোটি ৭৩ লাখ, ৭৮ কোটি ৫২ লাখ এবং ৮৭ কোটি ৪২ লাখ টাকা নিট লোকসান হয়েছে।

আলোচিত বছরগুলোর মধ্যে ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ সার্ভিসেস সবচেয়ে বেশি লোকসান করেছে। ওই দুই বছরে যথাক্রমে ১৮০ কোটি ৬৬ লাখ এবং ১১০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। ওই সময় দেশব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাব থাকায় হোটেলগুলোতেও বুকিং কম ছিল। এতে লোকসানের মাত্রা বড় হয়েছিল। চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসেও (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কোম্পানির বড় লোকসান হয়েছে। এই লোকসানের পরিমাণ ২৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির মোট ৯ কোটি ৭৮ লাখ শেয়ারের বিপরীতে পরিশোধিত মূলধন রয়েছে ৯৭ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৯৯ দশমিক ৬৮ শতাংশের মালিকানা সরকারের কাছে। বাকি দশমিক ৩২ শতাংশের মালিকানা রয়েছে বিদেশি ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে।

প্রসঙ্গত, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু হয়েছিল দেশের প্রথম পাঁচ তারকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের। স্থপতি উইলিয়াম বি ট্যাবলারের চমৎকার নকশার এ হোটেলটি আজও চমৎকার স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। এটি ইন্টারকন্টিনেন্টাল নামেই চলে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত। এরপর স্টারউড কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হওয়ায় ১৯৮৩ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ঢাকা শেরাটন হোটেল নামে এর বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলে। শেরাটনের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ‘রূপসী বাংলা হোটেল’ নামে এটি পরিচালিত হয়।

২০১২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি হোটেলটির বর্তমান মালিক কোম্পানি বাংলাদেশ সার্ভিসেস লিমিটেড ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলস গ্রুপ (এশিয়া প্যাসিফিক) প্রাইভেট লিমিটেডের (আইএইজি) সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ‘রূপসী বাংলা হোটেল’ বন্ধের পর ২০১৫ সালের মার্চে এর সংস্কারকাজ শুরু হয়। সংস্কারকাজ শেষে ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সার্ভিসেসের অধীনে ‘ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা’ নামে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়।

এমএমএইচ/এসএসএইচ