সকালের আলো ফুঁড়ে যখন একে একে স্কুলে ঢুকছিল শিক্ষার্থীরা, তখনই যেন কে সি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাঙ্গণ ভরে উঠছিল এক অন্যরকম উচ্ছ্বাসে। কোথাও রঙিন কাগজে সাজানো দরজা, কোথাও বাচ্চাদের হাতে আঁকা পোস্টার আবার কারও হাতে বিজ্ঞানভিত্তিক ছোট মডেল। সবমিলিয়ে পুরো ক্যাম্পাস পরিণত হয় সৃজনশীল এক কার্নিভ্যালে।

আবার ক্লাসরুমগুলো আর সেই পরিচিত চার দেয়াল নেই। কোনোটা বন-জঙ্গলের রূপ নিয়েছে, কোনোটা প্রকৃতি-বিজ্ঞানের ক্ষুদে প্রদর্শনী, আবার কোথাও পরিবেশ সচেতনতার রঙিন বার্তা। হাসি, কোলাহল আর প্রত্যাশায় উজ্জ্বল চোখ— এই মিলেমিশে তৈরি হয়েছিল শিক্ষার্থীদের স্বপ্নে রঙ মেশানো উৎসবের এক জীবন্ত চিত্র।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) সকাল থেকেই রাজধানীর দক্ষিণখানের এই স্কুলজুড়ে ছিল উৎসবের আমেজ। প্লে থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে ছিল নানা রকম থিম-ভিত্তিক সাজসজ্জা, পারফরম্যান্স, কেক কাটা ও আনন্দঘন মুহূর্তে ভরা এক অনন্য দিন। পড়াশোনার নিয়মিত চাপের বাইরে শিশুরা যেন নিজেদের ভেতরের রঙগুলো একসঙ্গে মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছিল এ আয়োজনের মাধ্যমে।

কে সি মডেল স্কুলের ক্লাস পার্টিতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভেতরের রঙগুলোকে মেলে ধরেছিল সৃজনশীলতার কার্নিভ্যালে / ঢাকা পোস্ট

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, স্কুলে ঢুকতেই চোখে পড়ে রঙিন ব্যানার, ক্লাসরুমের দরজায় ঝুলিয়ে রাখা সাজানো থিম বোর্ড আর বাচ্চাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ। শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন একের পর এক দলবদ্ধভাবে আসা শিশুদের। কেউ হাতে রঙ করা পোস্টার, কেউ বিজ্ঞানভিত্তিক মডেল, আবার কেউ বা প্রকৃতি থিমে সাজানো ছোট ছোট প্রজেক্ট নিয়ে এসেছে। যেন প্রতিটি শিশু সেই দিনের জন্য আলাদা করে প্রস্তুতি নিয়েছে।

বিশেষ করে থিম-ভিত্তিক ক্লাস সাজানোই ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে আনন্দের জায়গা। প্রথম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি ক্লাসই নিজেদের মতো করে পরিবেশ, প্রকৃতি, বিজ্ঞান, গবেষণা ও কল্পনার জগতকে তুলে ধরেছে। কোনো ক্লাসরুমে দেয়ালজুড়ে সবুজ বনভূমির চিত্র আর বন্যপ্রাণীর কাটআউট; কোথাও আবার ছাত্রছাত্রীদের হাতে বানানো নদী, পাহাড় বা ফুলের মডেল। কোনো ক্লাস আবার ‘সায়েন্স কর্নার’ তৈরি করে সেখানে দেখিয়েছে সহজ সব বৈজ্ঞানিক ধারণা।

পড়াশোনার চাপের বাইরে আনন্দময় শেখা! থিমভিত্তিক সাজসজ্জা, পারফরম্যান্স আর কেক কাটায় ভরে উঠল কে সি মডেল স্কুলের প্রাঙ্গণ / ঢাকা পোস্ট

এরপর সকাল ১০টার দিকে ছিল কেক কাটার অনুষ্ঠান। প্রতিটি ক্লাসেই আলাদাভাবে কেক কেটে আনন্দ ভাগাভাগি করে নেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় অন্যতম আকর্ষণ ছিল শিক্ষার্থীদের পারফরম্যান্স সেশন। কবিতা আবৃত্তি, গান, গ্রুপ পারফরম্যান্স, নৃত্য বা ছোট নাটিকা— সবমিলিয়ে প্রতিটি ক্লাসই রূপ নেয় ক্ষুদ্র উৎসবমঞ্চে।

শিক্ষকরা জানান, শুধু উৎসব নয় শিক্ষার্থীদের শেখাকে আনন্দমুখর করতেই এই আয়োজন। তাদের মতে, বইয়ের পাঠের বাইরেও শিশুদের শেখার অনেক ক্ষেত্র আছে যেমন— সাজসজ্জা, দলগতভাবে কাজ করা, পরিকল্পনা তৈরি, গবেষণার মৌলিক ধারণা ইত্যাদি। থিম-ভিত্তিক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা ঠিক সেভাবেই নিজেদের প্রতিভা ও কল্পনাশক্তিকে ব্যবহার করতে পেরেছে।

বইয়ের পাঠের বাইরেও শেখার ক্ষেত্র : দলগত কাজ, গবেষণা ও কল্পনাশক্তির চর্চা। বাচ্চারা রিসাইকেলড উপকরণ দিয়ে ক্লাস সাজিয়ে শিখেছে পরিবেশ সচেতনতা / ঢাকা পোস্ট

প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষিকা কামরুন নাহার রুমি বলেন, পড়াশোনা-পরীক্ষার চাপের বাইরে এ ধরনের উৎসব শিক্ষার্থীদের মনোসংযোগ বাড়ায়, শেখার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করে। বাচ্চারা দলগত কাজ শেখে, দায়িত্ব নিতে শেখে এবং নিজেদের মেধার জায়গাগুলো চর্চার সুযোগ পায়। ফলে তাদের মানসিক বিকাশেও ইতিবাচক প্রভাব পড়ে।

অনুষ্ঠানে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিরা বলেন, আমরা নিজেরা ক্লাস সাজিয়েছি। এটা করতে গিয়ে অনেক নতুন জিনিস শিখেছি। আমাদের ক্লাস ‘প্রকৃতি ও পরিবেশ’ থিম করেছে। আমরা রিসাইকেলড উপকরণ দিয়ে সাজাই, এতে শেখা হয়েছে কীভাবে বর্জ্য দিয়েও ভালো কিছু বানানো যায়।

নওরিন নামের আরেকজন বলেন, গান গাইতে প্রথমে ভয় লাগছিল, কিন্তু সবাই উৎসাহ দেওয়ায় সাহস পেয়েছি। এখন খুব ভালো লাগছে।

স্কুলের কর্তৃপক্ষও এমন আয়োজনকে নিয়মিত করার পরিকল্পনার কথা জানান। তারা বলেন, শিশুরা শুধু বইয়ের মাধ্যমে নয় অভিজ্ঞতা, পরিবেশ ও বাস্তব কাজের মধ্য দিয়ে শেখে। সেজন্য ক্লাস পার্টিকে শুধু বিনোদনের উৎসব নয়, বরং শেখার উৎসবে পরিণত করতে চান তারা।

নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে হাসি, কোলাহল আর উজ্জ্বল চোখে শিক্ষার্থীরা যেন নিজেদের স্বপ্নে রঙ মেশানোর সুযোগ পেল / ঢাকা পোস্ট

কে সি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের জুনিয়র উইংয়ের উপাধ্যক্ষ সালমা ফৌজিয়া নূর বলেন, আগে আমরা গল্পে শুনতাম আলাদীনের চেরাগ ঘষলে দৈত্য অসম্ভবকে সম্ভব করে দিত। এখন সেই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তির রোবট। ঠিক এই দুই যুগের কল্পনা আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধনই আমরা সাজিয়ে তুলেছি এবারের ক্লাস পার্টিতে। আলাদীনের দৈত্যের পাশাপাশি নানা রকম রোবট দিয়ে পুরো প্রাঙ্গণ সাজানোর মূল উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের ভেতরে সম্ভাবনা, কৌতূহল আর উদ্ভাবনী শক্তিকে জাগিয়ে তোলা। শিক্ষক আবুল হাশেম স্যারের তৈরি এসব শিল্পকর্ম দেখে বাচ্চারা বিস্ময়ে মুগ্ধ হয়েছে, আর অভিভাবকেরাও ছিলেন ছবি তোলার ব্যস্ততায়।

তিনি আরও বলেন, শিশুদের শেখাকে আনন্দময় করতে আমরা সবসময় চেষ্টা করি। এই আয়োজন বাচ্চাদের সৃজনশীলতা, দলগত কাজ, কল্পনাশক্তি ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। তাদের উচ্ছ্বাস দেখে আমরাও সত্যিই অনুপ্রাণিত। পড়াশোনার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতেই এমন উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।

শিক্ষকদের মতে, এটি শুধু উৎসব নয়, শেখার অংশ। দলগত কাজ ও দায়িত্ববোধের মধ্য দিয়েই শিশুরা বড় হচ্ছে / ঢাকা পোস্ট

এমন আয়োজন শিক্ষার্থীদের মধ্যে জানার আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করছেন কে সি মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান উপদেষ্টা ব্রি. জেনারেল (অব.) এ এস এম মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের চরিত্র গঠন, নৈতিকতা, নেতৃত্ব ও সৃজনশীলতা বিকাশে এ ধরনের কার্যক্রম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি আরও বলেন, আজকের আয়োজনে আমি যে উদ্দীপনা দেখেছি, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। বাচ্চাদের মধ্যে বিজ্ঞান, প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে এই প্রচেষ্টা ভবিষ্যতের জন্য বড় ভিত্তি গড়ে দেবে। আমরা চাই প্রতিটি শিক্ষার্থী নিজের স্বপ্নকে রঙিন করে এগিয়ে যাক।

আরএইচটি/এমজে