সুরে অবিনশ্বর রবিন ঘোষ
উপমহাদেশের খ্যাতিমান সুরকার ও সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষের মৃত্যুবার্ষিকী আজ (১৩ ফেব্রুয়ারি)। ২০১৬ সালের আজকের দিনে না ফেরার দেশে চলে যান অনেক কালজয়ী গানের এই স্রষ্টা। তাকে স্মরণ করে লিখেছেন নন্দিত গীতিকবি ও গবেষক শহীদ মাহমুদ জঙ্গী
এক.
বিজ্ঞাপন
প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী তালাত মাহমুদের ভাই ঢাকায় থাকতেন। সেই সুবাদে তিনি ঢাকায় আসেন। তরুণ নির্মাতা এহতেশাম সিদ্ধান্ত নিলেন ‘রাজধানীর বুকে’ সিনেমায় তালাতের কণ্ঠে গান যুক্ত করবেন। সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ। এই সিনেমার ইতিহাস হয়ে যাওয়া গীতিকবিতাটি লেখেন কে জি মোস্তফা।
২০২১ সালে এক সাক্ষাৎকারে এই গান প্রসঙ্গে কে জি মোস্তফা জানান, তিনি তখন ছাত্র। গানের কথা লেখার জন্য তাকে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি রবিন ঘোষের বাসায় যান। সেখানে গিয়ে জানলেন, সুরের ওপর গানের কথা বসাতে হবে। এ কথা শুনে কিছুটা শঙ্কিত হলেন। কারণ এতদিন নিজের মতো করে গান লিখেছেন। এখন সুরের ওপর লিখতে হবে।
বিজ্ঞাপন
রবিন ঘোষ গানের বিষয়ে ধারণা দিলেন। একইসঙ্গে দিলেন উৎসাহ। কিন্তু কে জি মোস্তফার মাথায় কিছুই আসছিল না। এদিকে রাত গভীর হচ্ছে। কে জি মোস্তফা এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চাইলেন। তার ভাষায়, ‘আমি ভাবলাম, আমি একটা কিছু লিখি। তারপর আমাকে বাদ দিয়ে দিক। এভাবে মুক্তি পেতে চেয়েছি।’
কে জি মোস্তফার ভাষ্য, সংগীতের একটা ছন্দ থাকে। তিনি সেভাবেই গানটি লেখার সিদ্ধান্ত নিলেন। লিখলেন ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে’। এক সময় গানের ‘স্থায়ী’ তৈরি হয়। সুরের কারণে একটি শব্দ বদলাতে বলেন রবিন ঘোষ। কে জি মোস্তফা তা বদলে দেন। রবিন ঘোষ সদ্য লিখিত স্থায়ীর কথাগুলো সুরে বসিয়ে গুনগুন করে গাইতে শুরু করেন। সে সময় সেখানে পরিচালক এহতেশাম আসেন। এহতেশাম গানের কথা পছন্দ করলে কে জি মোস্তফা ভীষণ অনুপ্রাণিত হন। সারা রাত চেষ্টার পর তিনি গানের বাকি অংশ লেখেন। সকালে রবিন ঘোষ কে জি মোস্তফাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে বেড়ান এবং পুরো গানের কথায় সুরে বসিয়ে বারবার গাইতে থাকেন। যেন, চলমান ঢাকা শহরকে সামনে রেখেই যাচাই করে নিচ্ছিলেন নিজের সৃষ্টিকে।
রবিন ঘোষের জন্ম ১৯৩৭ সালের ২৮ মে ইরাকের বসরা নগরীতে। রবিন ঘোষের বাবা আন্তর্জাতিক রেডক্রসে কাজ করতেন। বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরাকের বাগদাদ ছিল তার কর্মস্থল। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে তার বাবা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।
দুই
অল্প বয়সেই সংগীতকে পেশা হিসেবে বেছে নেন রবিন ঘোষ। ইন্টারমিডিয়েট (এখনকার এইচএসসি) পাসের পর আর পড়াশোনা শেষ করেননি। বরং কলকাতা গিয়ে প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ সলিল চৌধুরীর কয়্যার গ্রুপে যোগ দেন।
সলিল চৌধুরীর কয়্যার গ্রুপ থেকে রবিন ঘোষ শিখেছিলেন কীভাবে দক্ষতার সঙ্গে যথাযথভাবে মানসম্মত গান গাওয়া যায়। পরে যখন সংগীত পরিচালনায় আসেন তখন গায়ক বা গায়িকার কাছ থেকে সর্বোত্তম গায়কী আদায়ে এই শিক্ষা তাকে প্রচুর সাহায্য করে।
ঢাকায় ফিরে আসার পর সংগীত পরিচালক মুসলেহ উদ্দিনের সহকারী হিসেবে যোগ দেন রবিন ঘোষ। মুসলেহ উদ্দিন তখন শওকত হাশমি পরিচালিত উর্দু সিনেমা ‘হামসফর’-এর সংগীত পরিচালনা করছেন। কলকাতায় রবিন ঘোষের যোগাযোগ সূত্র ধরে হেমন্ত ও সন্ধ্যার কণ্ঠে দুটি গান ‘হামসফর’-এর জন্য রেকর্ড করেন মুসলেহ উদ্দিন।
তিন
১৯৩০-এর দশকের প্রথম দিকে প্রথম সবাক হিন্দি চলচ্চিত্র ‘আলম আরা’ (১৪ মার্চ ১৯৩১ সাল) ও প্রথম বাংলা সবাক ছবি ‘জামাই ষষ্ঠী’ (১১ এপ্রিল ১৯৩১ সাল) মুক্তি পায়।
ভারত ভাগের পর বেশিরভাগ কলা-কুশলী ভারতে থেকে যাওয়ায় এবং সবাক সিনেমা নির্মাণে পিছিয়ে থেকে শুরু করার কারণে যোগ্য মানুষের ঘাটতি নিয়েই কাজ শুরু করেন সেই সময়ের চলচ্চিত্র নির্মাতারা। ১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে মুক্তি পায় প্রথম সবাক উর্দু চলচ্চিত্র ‘তেরি ইয়াদ’। আর ৩ আগস্ট ১৯৫৬ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তি পায় প্রথম বাংলা সবাক সিনেমা ‘মুখ ও মুখোশ’। পরিচালনা করেন আব্দুল জব্বার খান। সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সমর দাস। ’মুখ ওমুখোশ’-এর পর ২৪ জুলাই ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় ফতেহ লোহানী পরিচালিত ‘আকাশ আর মাটি’। সংগীত পরিচালক ছিলেন সুবল দাস।২৮ আগস্ট ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় মহিউদ্দীন পরিচালিত ‘মাটির পাহাড়’। সংগীত পরিচালক ছিলেন সমর দাস। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৫৯ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘এ দেশ তোমার আমার’ মুক্তি পায়। সংগীত পরিচালক ছিলেন খান আতাউর রহমান।
মুক্তিপ্রাপ্ত এই কটি বাংলা ছবির মধ্যে গানের জন্য যে ছবিটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে সেটি মুক্তি পায় ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে। ছবির নাম ‘রাজধানীর বুকে’। গানটি হলো— ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো, চাঁদ বুঝি তা জানে’।
১৯৬১ সালের ৪ আগস্ট মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিটি মুক্তি পায়। সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ। এবার ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’তে মজে থাকা অগণিত শ্রোতাকে একটানে ভিন্ন মেজাজে নিয়ে যান রবিন ঘোষ। ফেরদৌসি রহমানকে দিয়ে গাওয়ান, ’আমি রূপনগরের রাজকন্যা, রূপের যাদু এনেছি’। এ গানের জনপ্রিয়তায় রবিন ঘোষ যেন নিজের রেকর্ড নিজে ভাঙলেন। এই গান সর্বস্তরের শ্রোতার প্রিয় গানে পরিণত হয়।
১৬ নভেম্বর ১৯৬২ সালে মুক্তি পায় চলচ্চিত্র ‘নতুন সুর’। ছবির পরিচালক এহতেশাম। সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ। গানগুলো কে জি মোস্তফার লেখা। ‘কে স্মরণের প্রান্তরে, চুপিচুপি ছোঁয়া দিয়ে যায়’ গাইলেন আঞ্জুমান আরা বেগম। বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া এক গান। এটি ‘আমি রূপনগরের রাজকন্যা’ থেকে ভিন্ন মেজাজের। সুরের উপর রবিন ঘোষের অসাধারণ দখল এবং সুরের আভিজাত্য ও বৈচিত্র্য উল্লেখিত তিনটি গানেই ফুটে উঠেছে।
চার
তখন উর্দু ছবির বাজার সারা পাকিস্তান জুড়ে। এহতেশাম উর্দু ছবি তৈরি করলেন। নাম ‘চান্দা’। মুক্তি পায় ১৯৬২ সালে। সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ। ফেরদৌসি রহমান গাইলেন- ‘আঁখিয়া তেরে রাত নেভায়া, ও পর দেশিয়া আজা..’। ব্যাপক হিট। ১৯৬৩ সালে এহতেশাম পরিচালিত উর্দু ছবি ‘তালাশ’ মুক্তি পায়। সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ। বশির আহমদ গাইলেন ‘ম্যায় রিক্সাওয়ালা মাতাওয়ালা’। এই গান, চলতি ভাষায় যাকে বলে, সুপার-ডুপার হিট হয়। ছবির সফট রোমান্টিক গান ‘কুচ আপনি কেহিয়ে, কুচ মেরে সুনিয়ে’ও দারুণ হিট হয়। গানটিতে আলাদাভাবে কণ্ঠ দিয়েছেন বশীর আহমদ ও ফেরদৌসি রহমান।
১৯৬৭ সালে মুক্তি পায় এহতেশাম পরিচালিত ‘চকোরি’। সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষ। এটি পাকিস্তানের দ্বিতীয় প্লাটিনাম জুবিলি চলচ্চিত্র। এর গান ‘কাভি তো তুমকো ইয়াদ আয়েগি’তে কণ্ঠ দেন আহমদ রুশদি। নাদিম ও ফেরদৌসি রহমান দ্বৈত কণ্ঠে গাইলেন- ‘কাহাঁ হো তুমকো দূর রাহি হ্যায়’। মুজিব আলম গাইলেন ‘ও মেরে সামনে, তাসবির বনে ব্যেইঠে হেঁ’। তিনটি গানই শ্রোতামহলে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়।
অবিভক্ত পাকিস্তানে রবিন ঘোষের জনপ্রিয়তা বিপুলভাবে বৃদ্ধি পায়। পশ্চিম পাকিস্তানেও রবিন ঘোষের কাজের চাহিদা প্রচুর বেড়ে যায়। উর্দু ছবিতে নায়িকা হিসেবে শবনমের অবস্থানও তখন তুঙ্গে। ১৯৬৮ সালে ‘তুম মেরি হো’ মুক্তির পর পেশাগত কারণেই লাহোরে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন রবিন ঘোষ ও শবনম।
পাঁচ
১৯৭০ সালে মুক্তি পায় ‘পীচ ঢালা পথ’। আবার এহতেশাম। পরিচালনায় এহতেশাম থাকা মানে একটা ঝকঝকে সুন্দর ছবি। আর তার সঙ্গে সংগীত পরিচালক হিসেবে যদি যুক্ত হন রবিন ঘোষ তাহলে তো কথাই নেই। সেই ছবি স্মার্ট এবং সফল হতে বাধ্য। এই ছবির কয়েকটি গান স্মরণে আনলেই এই কথার সত্যতা বোধগম্য হবে।
আহমদ জামান চৌধুরীর কথায় মোহাম্মদ আবদুল জব্বার গেয়েছেন, ‘পীচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি’, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছেন, ‘ভুলে গেছি সুর ওগো স্বরলিপি নেই’, আহমদ জামান চৌধুরীর কথায় সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছেন, ‘ঝড়ের পাখি হয়ে উড়ে’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের কথায় শাহনাজ রহমতউল্লাহ গেয়েছেন, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে, চুপিচুপি বলে যায়’।
এই চারটি গানের সঙ্গে ১৯৭১ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তিপ্রাপ্ত অশোক ঘোষ পরিচালিত ‘নাচের পুতুল’ ছবির একটি গান যোগ করি- ‘আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন’। কে জি মোস্তফার কথায় রবিন ঘোষের সুরে গেয়েছেন মাহমুদুন্নবী।
‘নাচের পুতুল’ ছবির এই গান এবং ‘পীচ ঢালা পথ’-এর চারটি গান শুনলে, যে কেউ বুঝতে পারবেন তার প্রতিটি গানের সুরের আলাদা চরিত্র, আলাদা বৈশিষ্ট্য। আর এই সব কিছু মিলিয়েই রবিন ঘোষ সৃষ্ট সংগীতের এ নতুন ধারা। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সিনেমার অনেক গান এই ধারায় তৈরি হয়েছে। এখনো অনেক সুরকার এই ধারা অনুসরণ করেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে।
ছয়
রবিন ঘোষের গানের কেতাদুরস্ত স্টাইল ততদিনে সারা পাকিস্তানে ভীষণভাবে শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তিনি বাংলাদেশের একমাত্র সুরকার যার সুর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের সীমানা পেরিয়ে উপমহাদেশের কোটি কোটি শ্রোতার মন ছুঁয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালে ‘চাহাত’ ছবির সংগীত পরিচালনা করেন রবিন ঘোষ। তার সুরে মেহেদী হাসান গাইলেন, ‘পেয়ার ভরে দো শর্মিলি নেয়িঁ’, এই গান বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ব্যাপক হিট হয়।
এ ছাড়া ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আয়না’ ছবিতে রবিন ঘোষের সুরে মেহেদী হাসান গাইলেন ‘মুঝে দিলসে না ভুলানা’। এই গানও ভারত-বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে হিট হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে পাকিস্তানের সুপরিচিত পত্রিকা ডন জানায়, রবিন ঘোষ ৭টি নিগার পুরস্কার লাভ করেন। যা অন্য কোন কম্পোজার অর্জন করেননি। পাকিস্তানে নিগার পুরস্কারকে ভারতের ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কারের সমতুল্য মনে করা হয়।
রবিন ঘোষ ১৯৯৮ সালে স্থায়ীভাবে ঢাকায় ফিরে আসেন। একজন গুণী কম্পোজার হিসেবে উপমহাদেশে তার প্রচুর ভক্ত আছে। প্রচুর সম্মানও পেয়েছেন বিদেশে। কিন্তু বাংলাদেশের ফিল্মে উন্নত ধারার সংগীতের পথিকৃৎ রবিন ঘোষ বাংলাদেশে প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি। হয়তো কিছুটা অভিমান নিয়েই ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।
আরআইজে/জেএস