ইনফোগ্রাফ / ঢাকা পোস্ট

বিএনপির বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দখল, খুন-ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। এসব ঘটনায় দল হিসেবে বিব্রত বিএনপি। দলের কোনো কোনো নেতা মনে করছেন, এখনই নেতাকর্মীদের থামানো না গেলে এর প্রভাব আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, দলের পক্ষ থেকে কোনো অপরাধীকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না। যখন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে, সঙ্গে-সঙ্গে সাংগঠনিক এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে না আসায় ঠিকই দলের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বারবার বিব্রত হতে হচ্ছে দলকে।

মিটফোর্ডে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর চাপের মুখে বিএনপি : দলীয় অন্তর্কোন্দল ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বাড়ছে উদ্বেগ / ঢাকা পোস্ট

দলের সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের আগস্ট মাস থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে কারণ দর্শানো, বহিষ্কার, সতর্ক করা, সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ দেওয়া হয়েছে বিএনপির ৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে। শুধু তাই নয়, অনেকের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। কেউ খুন, রক্তপাত বা সহিংসতায় জড়ালে বিএনপিতে তার কোনো স্থান নেই। হয়তো অনেক অপরাধী ও সন্ত্রাসী নানা ছিদ্রপথে সংগঠনে ঢুকে যেতে পারে। কিন্তু তাদের দুষ্কর্মের দায় বিএনপি নেবে না। বরং এ ব্যাপারে দল খড়্গহস্ত।

গত ৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা বিএনপির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। দিনের আলোয় সংঘটিত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় এবং বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

ভাবমূর্তি সংকটে বিএনপি? দলীয় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে / ঢাকা পোস্ট

এ ছাড়া, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এই ইস্যুতে বিএনপির কঠোর সমালোচনা করে।

এ ঘটনার পর বিএনপি তাদের তিন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থেকে পাঁচজনকে বহিষ্কার করলেও দলটির বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চলছেই। এ ধরনের প্রচারণাকে পরিকল্পিত ও নোংরা রাজনীতির চর্চা বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা।

মিটফোর্ডের ঘটনার পর প্রকৃত অর্থেই ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে বিএনপি। এ কারণে রাখঢাক না করে তারা একাধিকবার হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়।

রাজনৈতিক সহিংসতায় বিএনপি : পরিসংখ্যান

গত ৭ জুলাই প্রকাশিত হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে অন্তত ৫২৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৭৯ জন নিহত এবং ৪ হাজার ১২৪ জনের বেশি আহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ৩০২টি ঘটনায় ২ হাজার ৮৩৪ জনের বেশি আহত এবং ৫৪ জন নিহত হয়েছেন। বাকি ১৪০টির বেশি ঘটনায় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে অন্যান্য দলের সদস্যদের সংঘর্ষ হয়েছে।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে জুনের মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ অন্তত ৪০৯টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৩৫ জন নিহত এবং এক হাজার ১০৫ জন আহত হয়েছেন।

রাজনৈতিক সহিংসতার পরিসংখ্যান: জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৫২৯টি ঘটনা, এর মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলেই নিহত ৫৪ জন / ঢাকা পোস্ট

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এসব ঘটনা বিএনপির ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যার প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়তে পারে। তবে, বিএনপির শীর্ষ নেতারা এই ঘটনাকে আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলার ‘পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র’ বলে মনে করছেন ।

‘ষড়যন্ত্র’ দেখছেন তারেক রহমান ও শীর্ষ নেতারা

গত শনিবার রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, যাকে আমরা স্ক্রিনে দেখেছি, যে হত্যা করছে, তাকে কেন সরকার এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করেনি? আমরা কি তবে ধরে নেব, যারা বিভিন্নভাবে মব সৃষ্টি করে একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে, সেখানে সরকারের কোনো প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে? প্রশাসনের কোনো প্রশ্রয় আছে?’

তারেক রহমান আরও বলেন, ‘ষড়যন্ত্র কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আমি ৮-৯ মাস আগেই বলেছি, অদৃশ্য শত্রু আছে। ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে সেই অদৃশ্য শত্রু। ষড়যন্ত্র আরও জোরেশোরে শুরু হচ্ছে।’

অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বিএনপি নেতাকর্মীরা : দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ৭ হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ / ঢাকা পোস্ট

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘মিটফোর্ডের ঘটনায় সিরিয়াস ব্যবস্থা নেওয়ার পরও, বিচ্ছিন্ন ঘটনার দায় বিএনপির ওপর চাপানো অপরাজনীতি, এটা নোংরা রাজনীতির চর্চা। বিএনপি কোনো অপরাধীকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না, কোনোদিন দেবেও না। এক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’। 

তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন মহল এটা নিয়ে হীন রাজনীতির চেষ্টা করছে। তা না হলে তারেক রহমান জবাব দাও, এই মিছিল কেন। তারেক রহমান কি রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন? বিএনপি যদি অপরাধীদের রক্ষা করার চেষ্টা করত, সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নিত, তাহলে দোষ দিতে পারত।’

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, বিএনপি অপরাধকে অপরাধ হিসেবে দেখে, সেখানে দলের বা নিজের এভাবে কিছু বিবেচনায় নেওয়া হয়নি এবং নেওয়া হবে না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন,  সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে সরকার উচ্চপর্যায়ে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। দেশবাসী বিশ্বাস করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত আসামি চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসবে।

নেতিবাচক প্রচারণা নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিএনপির বেশ কিছু কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ ওঠে। দলের দুইজন স্থায়ী কমিটির সদস্যের বিরুদ্ধেও আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ আসে। এসব ঘটনায় তখন দল হিসেবে বিএনপিকে বিব্রত হতে হয়েছে। যা পরবর্তীতে কিছুটা কাটিয়ে ওঠা গেছে। এখন আবার সারা দেশে নেতাকর্মীদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের ঘটনা প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এসব ঘটনায় দল হিসেবে বিএনপি এবং শীর্ষ নেতৃত্ব বিব্রত।

ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি : মিটফোর্ডের ঘটনায় সরকারের প্রশ্রয় দেখছেন তারেক রহমান ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা / ঢাকা পোস্ট

তিনি বলেন, নেতাকর্মীদের এই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বিএনপির ওপর আগামী সংসদ নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নেতাকর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দলের প্রতি সাধারণ ভোটারদের আস্থা নষ্ট করছে। বিশেষ করে তরুণ ও নতুন ভোটারদের মাঝে নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে। এতে করে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়বে বিএনপি।

এই নেতা আরও বলেন, তবে দলের ভাবমূর্তি রক্ষা এবং জনআস্থা ফেরানোর  লক্ষ্যে ইতোমধ্যে অভ্যন্তরে ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অপরাধ ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আসবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পদক্ষেপ না নিলে সংকটে পড়বে দল

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি যদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারে, তাহলে আগামী নির্বাচনে দলটি নতুন করে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়তে পারে। তবে এখনই যদি শক্ত হাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারে, তাহলে পরিস্থিতি আবার তাদের অনুকূলে যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাদেশর মানুষ দলীয় প্রতীক ও জাতীয় রাজনীতির অবস্থান দেখে ভোট দেয়। সেই কারণে বলা কঠিন যে এই ধরনের ঘটনাগুলো জাতীয় নির্বাচনকে প্রভাবিত করবে। তবে, এসব ঘটনা নিন্দনীয়।

তিনি বলেন, বিএনপি ইতোমধ্যে প্রায় ৭ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। দল হিসেবে আসলে এর বেশি কিছু করার নেই। কারণ তাদের তো আইন প্রয়োগের সুযোগ নেই। দল কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। বিএনপি যদি বহিষ্কার না করত তাহলে তার দায় থাকত। বহিষ্কার করায় দায় কমেছে।

অপরাধীর কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই : শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থান বিএনপির, তবে নেতিবাচক প্রচারণা অব্যাহত / ঢাকা পোস্ট

তিনি আরও বলেন, আইন প্রয়োগ করতে পারে সরকার। এখন মূল দায় সরকারের। তাদের অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। সরকার অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিলে তখন অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিএনপিকে জিরো টলারেন্স থাকতে হবে।

এই অধ্যাপকের দাবি,  বাংলাদেশে আগে অপরাধীদের দল থেকে বহিষ্কার করার উদ্যোগ খুব একটা ছিল না। এটা ভালো উদ্যোগ। এখন বিএনপির দায়িত্ব হচ্ছে ভবিষ্যতে এসব অপরাধীরা যেন দলে স্থান না পায় সেদিকে খেয়াল রাখা। 

এএইচআর/এনএফ