করোনাভাইরাস পরিস্থিতি
১২ দিনে করোনার সর্বোচ্চ রেকর্ড, মৃত্যু ৭৭৬ জনের
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর নতুন রেকর্ড। চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে ( সোমবার পর্যন্ত) এ ভাইরাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্ত হয়েছেন। একই সময়ে বেড়েছে নমুনা পরীক্ষার পরিমাণও। উল্লেখিত সময়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৭৭৬ জন।
সোমবার (১২ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করোনায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা দেশে ভাইরাসটিতে একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর নতুন রেকর্ড। গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যুর এ সংখ্যা। এ নিয়ে করোনাভাইরাসে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮২২ জনে। একই সময়ে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৭ হাজার ২০১ জন। এতে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়ে ৬ লাখ ৯১ হাজার ৯৫৭ জনে।
বিজ্ঞাপন
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে গতকাল ১২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে ৯ হাজার ৮২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বছরের ১৮ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত করোনায় মোট মৃত্যু ছিল ২৫০ জন। অপরদিকে ওই বছরের ১২ জুন পর্যন্ত দেশে করোনায় মোট মৃত্যু ছিল ১ হাজার ৯৫ জন। এরপর থেকে মৃত্যু কিছুটা বেড়ে যায়। এর মধ্যে জুলাইয়ে ১ হাজার ১০২ জন, আগস্টে ১ হাজার ৩১৬, সেপ্টেম্বরে ১ হাজার ১৮৯, অক্টোবরে ৮৫৩ , নভেম্বরে ৫৮৫ ও ডিসেম্বরে মারা যান ৮৮০ জন। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে করোনায় মৃত্যু হয় ৭৯৯ জনের। ফেব্রুয়ারিতে আগের মাসগুলোর তুলনায় মৃত্যুহার অনেক কম ছিল। ওই মাসে মারা যান ৪৩৪ জন। এ কারণে অনেকেই মনে করেছিলেন বাংলাদেশে করোনা ঝুঁকি কমে গেছে। এরপর মার্চ থেকে ধারাবাহিকভাবে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের দক্ষিণ আফ্রিকান ও ইউকে ভ্যারিয়েন্ট দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এই দুইটি ভ্যারিয়েন্ট খুবই সংক্রামক। ফলে মার্চে নতুন সংক্রমণ বাড়ে প্রচুর কিন্তু সে তুলনায় মৃত্যু বেশি ছিল না। মার্চে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৬২ জন। সে তুলনায় চলতি মাসের প্রথম ১২ দিনে মৃত্যু হয়েছে ৭৭৬ জনের। মৃত্যু সংখ্যা বাড়তে থাকায় আতঙ্কিত চিকিৎসকরাও। আগামীতে এ মৃত্যুর হার আরও বাড়ার আশঙ্কা তাদের।
বিজ্ঞাপন
এদিকে চলতি মাসে নমুনা পরীক্ষার হারও বেড়েছে অনেক। গতকাল সর্বোচ্চ ৩৪ হাজার ৯৬৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। অপরদিকে এ মাসেই আরও কয়েকটি পরীক্ষা কেন্দ্র বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা অন্যতম। দেশে সরকারি ১০০টি অ্যান্টিজেন পরীক্ষাগার রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি মিলে মোট ১২১টি আরটি পিসিআর পরীক্ষাগার রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ৫২টি। অপরদিকে যক্ষ্মার জীবাণু পরীক্ষার যন্ত্র জিন এক্সপার্ট মেশিনগুলোকেও এখন করোনা পরীক্ষার কাজে লাগানো হচ্ছে। এ ধরনের মেশিন রয়েছে ৩৪টি। এর মধ্যে সরকারি মেশিন ৩২টি। সব মিলে দেশে করোনা পরীক্ষাগার রয়েছে ২৫৫টি।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাসপাতালগুলোয় রোগীর জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। আইসিইউ সংকট দেখা দিয়েছে; এগুলো তো বাস্তবতা। সেবা বাড়াতে হলে হাসপাতালের সংখ্যা বাড়াতে হবে। দরকার হলে স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ খোলা মাঠকে হাসপাতালে রূপান্তর করতে হবে। এগুলো পরিচালনায় আরও চিকিৎসক-নার্স নিয়োগ দিতে হবে। জনবল না থাকলে হাসপাতাল বানিয়ে লাভ কী?
তিনি বলেন, প্রচুর টাকা খরচ করে সরকার গত বছর যে হাসপাতালগুলো করল, সেগুলোর অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারে অসংখ্য যন্ত্রপাতি পড়ে আছে, অথচ হাসপাতালগুলোয় রোগীর জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। অনেক মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। ঢাকা মেডিকেল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেলের সামনে মানুষ ভর্তির জন্য ভিড় করছেন। সিরিয়াল পাচ্ছেন না। রোগীরা অক্সিজেন পাচ্ছেন না, আইসিইউ তো নাই-ই। আইসিইউর অভাবে প্রচুর রোগী মারা গেছেন। হাসপাতালের সঙ্গে সঙ্গে এগুলোও বাড়াতে হবে।
সোমবার (১২ এপ্রিল) সরেজমিনে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঢামেক ঘুরে দেখা গেছে, করোনা ইউনিটে ভর্তির জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সে অপেক্ষা করছেন রোগীরা। সিট খালি নেই, তবু অপেক্ষা যদি একটা সিট মেলে।
ঢামেক করোনা ইউনিটে ওয়ার্ড, সিসিইউ, এইচডিইউ ও কেবিন মিলিয়ে ৫৯৩টি বেড আছে। আইসিইউ আছে মাত্র ২০টি। রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেবাদিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক ঢাকা পোস্টকে বলেন, এখানে যে পরিমাণ শয্যা আছে তার চেয়ে ২-৩ গুণ বেশি রোগী আসলে আমরা কীভাবে চিকিৎসা দেবো? আমরা চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। কিন্তু অনেকে ভাবে সিট থাকতেও দেওয়া হয় না। আমরা অতিরিক্ত কিছু বেড দিয়ে তাদের চিকিৎসা করছি। বেড খালি হলে নতুন আরেকজনকে দিচ্ছি। এখানে আমাদের এর চেয়ে বেশি কিছু করার থাকে না। আপনি যদি আমার জায়গায় থাকতেন তাহলে কত রকমের কথা শুনতে হয় বুঝতে পারতেন।
সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ নেই
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোয় থাকা ১২৯টি আইসিইউর মধ্যে রোববার (১১ এপ্রিল) বিকেল পর্যন্ত মাত্র ৩টি খালি ছিল। একটি মুগদা মেডিকেলে আর দুটি রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে। বেসরকারি হাসপাতালে ৩৭৭টি আইসিইউর মধ্যে খালি রয়েছে মাত্র ৭টি।
শয্যা খালি নেই হাসপাতালে
ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোয় করোনা আক্রান্ত রোগী ভর্তি হওয়ার মতো কোনো বেড খালি নেই। সরকারি হাসপাতালের করোনা ইউনিটের মধ্যে ২৮০০ বেডের মধ্যে মাত্র ৩০০টি বেড খালি রয়েছে। তবে সেগুলো বিশেষায়িত রোগীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে।
ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রি. জে. নাজমুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনা আক্রান্তদের জন্য ঢাকা মেডিকেলের নতুন ও পুরাতন বার্ন ইউনিট ভবনে মোট ৮০০টি বেড রয়েছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) আছে ২০টি এবং হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ) আছে ৪০টি। আইসিইউ এবং এইচডিইউতে কোনো সিট খালি নেই। করোনা ইউনিটে গাইনি এবং সার্জারি বিভাগে কিছু সিট খালি আছে, তবে সেগুলোতে অন্য করোনা রোগী ভর্তি করা হয় না। কারণ হঠাৎ করে গর্ভবতী করোনা রোগী বা সার্জারির রোগী এলে তাদের সেখানে ভর্তি রাখা হয়।
টিআই/এসকেডি