সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় এখন এক অদৃশ্য সংকট ঘনীভূত হচ্ছে— যার নাম ক্যাডার বিভাজন। প্রশাসনিক জটিলতা আর রিট মামলার বেড়াজালে আটকে আছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার চিকিৎসকের পদোন্নতি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি নিয়মকানুন মেনে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিয়োগ ও ক্যাডারভুক্ত হওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। এর মূল কারণ হিসেবে তারা স্বাস্থ্য ক্যাডারের কিছু চিকিৎসক কর্তৃক দায়ের করা রিট মামলাকে দায়ী করেছেন, যার ফলে পুরো পদোন্নতির প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে গেছে।

মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত অ্যাসোসিয়েশন থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

এতে বলা হয়, পদোন্নতির জন্য সুপারনিউমেরারি পদ সৃষ্টির উদ্যোগ নিলেও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কিছু চিকিৎসক আদালতে রিট দায়ের করে পুরো প্রক্রিয়াটিকে স্থগিত করে দিয়েছেন। অথচ সরকারি নিয়মকানুন মেনে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়োগ ও ক্যাডারভুক্ত হওয়া এই চিকিৎসকদের মধ্যে অনেকে এক যুগ ধরে একই পদে থেকে যাচ্ছেন, যা কেবল ব্যক্তিগত বঞ্চনা নয় প্রশাসনিক অদক্ষতার প্রতিফলনও।

সরকারি স্বাস্থ্য খাতে শূন্যপদ পূরণের প্রচেষ্টা

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০১০-১১ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৪ হাজার ১৩৩টি শূন্যপদে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে চিকিৎসক নিয়োগ দিয়েছিল। প্রথমে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে ২০১৫ সালে নন-ক্যাডার চিকিৎসকদের ধাপে ধাপে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে নিয়মিত করা হয়। ২০২২ সালে আবার ২ হাজার ১ জন চিকিৎসক বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত হন এবং একই বছর আরও ১ হাজার ৯৮৯ জনকে ক্যাডারভুক্ত করা হয়।

তবে এই পদোন্নতি প্রক্রিয়ার শুরুতে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কিছু চিকিৎসক ক্যাডারভুক্তদের বিরুদ্ধে রিট দায়ের করেন, যা এখন আইনি জটিলতা তৈরি করেছে এবং নতুন পদোন্নতি স্থগিত হয়ে গেছে। এই রিটের ফলে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসকরা তাদের পদোন্নতির প্রক্রিয়া স্থগিত হওয়ার কারণে আরো বঞ্চিত হচ্ছেন।

বিভাজন এবং আইনগত জটিলতা

বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারভুক্ত চিকিৎসক অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক ডা. মো. জাকির হুসেইন বলেন, আমরা আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি যাতে আমাদের অধিকার রক্ষা করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্য ক্যাডারের একটি অংশ রিটকে অপব্যবহার করছে এবং বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। আসলে আদালতের স্থগিতাদেশ সবার পদোন্নতির পথ আটকে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এই রিটের মাধ্যমে দাবি করা হচ্ছে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডার চিকিৎসকরা পদোন্নতির প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। আদালতের স্থগিতাদেশে স্পষ্ট বলা হয়েছে, সব পক্ষের পদোন্নতি আপাতত স্থগিত থাকবে।

দীর্ঘ প্রতীক্ষা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সচিব ডা. মো. জাহীদ ইকবাল জানান, আমরা এক যুগ ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় আছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় এই বৈষম্য স্বীকার করা হয়েছে। আমাদের জন্য এটি কেবল পদোন্নতি নয়, এটি আমাদের পেশাগত সম্মানের প্রশ্ন।

তিনি আরও বলেন, ২০২২ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে ইনক্রিমেন্ট প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে আদেশ জারি করলেও, সেই আদেশের পরেও পদোন্নতির কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। ২০২২ সালে যখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রায় দুই হাজার চিকিৎসককে ক্যাডারভুক্ত করার প্রজ্ঞাপন জারি করে, তখন স্বাস্থ্য ক্যাডারের একটি অংশ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে এবং আদালত থেকে স্থগিতাদেশ লাভ করে।

প্রশাসনিক স্থবিরতা ও ঝুঁকি

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই প্রশাসনিক বিভাজন ও অচলাবস্থা জনস্বাস্থ্য সেবাকে বিপদে ফেলছে। একদিকে, সিনিয়র চিকিৎসকরা পদোন্নতি না পাওয়ার কারণে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় স্থবিরতা দেখা দিচ্ছে। এতে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, রোগী সেবা ও কর্মসংস্থান সবকিছুতেই দুর্বলতা সৃষ্টি হচ্ছে।

নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এই সংকট যদি দ্রুত সমাধান না হয়, তবে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হতে পারে।

স্বাস্থ্য খাতের নেতারা বলছেন, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং বিভিন্ন পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে একটি সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। তারা আশা করছেন, সরকারের কাছে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে, যাতে স্বাস্থ্যখাতে একটি স্বচ্ছ, ন্যায্য ও কার্যকরী পদোন্নতি প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করা যায়।

এমনকি, তারা যুক্তি দেন— এটি কেবল একটি পদোন্নতির প্রশ্ন নয় বরং পুরো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ এখন ন্যায্যতা এবং সঠিক নীতির প্রয়োগের ওপর নির্ভর করছে।

টিআই/এমজে