বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প এক ভয়াবহ সংকটের মুখে। অন্তত এক হাজার নতুন ওষুধ দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিবন্ধনের অপেক্ষায় পড়ে আছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে। অথচ এই নিবন্ধন আগামী তিন মাসের মধ্যে সম্পন্ন না হলে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব আইন ‘ট্রিপস’-এর পূর্ণ শর্ত মানতে বাধ্য হবে বাংলাদেশ। এতে করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর ওপর পড়বে উচ্চ হারে রয়্যালটি বা পেটেন্ট গ্রহণের চাপ, ফলে সাধারণ মানুষের জন্য ওষুধ হয়ে উঠবে ব্যয়বহুল।

শনিবার (২ আগস্ট) বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতি ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা ওষুধ শিল্পে চলমান সংকট এবং ভবিষ্যৎ ঝুঁকি নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

ডেল্টা ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব ডা. মো. জাকির হোসেন বলেন, আমরা ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় যাচ্ছি। তবে ২০২৫ সালের নভেম্বর থেকেই নতুন ওষুধে ট্রিপসের শর্ত মানতে হবে। তখন নিবন্ধন ছাড়া ওষুধ আনা যাবে না, আর আনলেও তা হবে রয়্যালটি দিয়ে অথবা ব্যয়বহুল পেটেন্ট নিয়ে। অথচ এখনো অন্তত এক হাজার ওষুধ অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। আমাদের দাবি, এই সময়সীমার আগে সবগুলো ওষুধ নিবন্ধন দিয়ে দেওয়া হোক।

তিনি আরও বলেন, এতদিন পর্যন্ত আমরা স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) সুবিধা নিয়ে ওষুধ উৎপাদন ও রপ্তানিতে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেয়ে এসেছি। এখন সেই সুযোগটা হারানোর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি।

রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ কায়সার কবির বলেন, শুধু ওষুধ শিল্প নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও উন্নয়নশীল দেশের উত্তরণ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এলডিসি অবস্থায় আমরা ট্রিপসের ছাড়, স্বল্প সুদের ঋণসহ অনেক সুবিধা পেয়ে আসছি। এখনো সময় আছে, অন্তত ৩ থেকে ৪ বছর গ্র্যাজুয়েশনের ট্রানজিশন পিছিয়ে নেওয়া দরকার, যেমন সেনেগাল বা কম্বোডিয়া করেছে।

‘এপিআই’ শিল্পপার্ক : ১৭ বছরে কারখানা মাত্র চারটি

উল্লেখযোগ্যভাবে, ২০০৭ সালে সরকার ‘অ্যাকটিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্ট’ (এপিআই) শিল্প গড়ে তুলতে গজারিয়ায় ২০০ একর জমি বরাদ্দ দিলেও গত ১৭ বছরে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান সেখানে কার্যক্রম শুরু করেছে। এ প্রসঙ্গে ডা. জাকির হোসেন বলেন, চীনের কিছু কোম্পানি আমাদের পার্ক দেখে বলেছে, প্লটগুলো ছোট, গ্যাস সরবরাহ নেই, অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। তাই অনেকে কাজ শুরু করতে পারেনি।

তিনি জানান, নীতিমালা কিছুটা সংশোধন হয়েছে, কয়েকটি কোম্পানি যৌথভাবে কাজ শুরুর প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং আশা করা হচ্ছে ২০২৬ সালের মধ্যে ১০-১২টি প্রতিষ্ঠান ফ্যাক্টরি স্থাপন করবে।

মানসম্পন্ন উৎপাদন কিন্তু ব্যয় বাড়াচ্ছে প্রক্রিয়া

ওষুধ উৎপাদনের জটিলতা এবং ব্যয় নিয়ে আলোচনায় রেনেটার ভাইস চেয়ারম্যান কায়সার কবির বলেন, অনেকেই মনে করেন, কাঁচামাল আর প্যাকেজিং খরচ দিয়েই ওষুধের দাম নির্ধারণ হয়। বাস্তবতা হলো– আজকের দিনে ওষুধ বানানো মানে বহু ধাপে যাচাই ও নিশ্চয়তা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়া। কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্সে অনেক বিনিয়োগ লাগে।

তিনি আরও বলেন, এখনকার ওষুধ তৈরি করা আর ৮০’র দশকের মতো নয়। আধুনিক প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ধাপে জটিল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হয়। শুধু মেশিন থাকলেই হয় না, দক্ষ জনবল এবং মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা লাগেই।

রপ্তানি ওষুধ খাতের আশাবাদ কিন্তু সামনে ঘন মেঘ

ইউনিমেড ইউনিহেলথের চেয়ারম্যান এম মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠিন বাজারেও কিছু কোম্পানি ইউএস এফডিএ অনুমোদন পেয়েছে। এটা গর্বের বিষয়।

তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে ওষুধের চাহিদা থাকায় বাংলাদেশ সামনের দিনে অনেক বড় বাজার পেতে পারে। উদাহরণ হিসেবে ফিলিপাইন ৭৩ শতাংশ ওষুধ আমদানি করে, ভিয়েতনাম ২০৪৫ সালের মধ্যে আমদানি ৫০ শতাংশ কমাতে চায়। কিন্তু বাংলাদেশ মাত্র ২ শতাংশ ওষুধ আমদানি করে, বাকিটা নিজে তৈরি করে। ফলে আমাদের সক্ষমতা রয়েছে।

সিদ্ধান্ত এখন সরকারের হাতে

বক্তারা বলেন, এই মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো– আগামী নভেম্বরের আগেই মুলতবি থাকা সব ওষুধের নিবন্ধন দিয়ে দেওয়া এবং ট্রিপস বাধা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং বাড়ানো।

তাদের মতে, যদি এই সরকার না করে, তাহলে নির্বাচনের পর নতুন সরকার আসলে এ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ ওষুধ খাত বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান রপ্তানি সম্ভাবনাময় খাত।

মতবিনিময় সভায় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সমিতির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান, কোষাধ্যক্ষ ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সিইও মুহাম্মদ হালিমুজজামান এবং সমিতির সদস্য ও নিপরো জেএমআই ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুর রাজ্জাকসহ বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের নেতারা, স্বাস্থ্য খাত সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমকর্মী এবং ওষুধ শিল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

টিআই/এসএসএইচ