ভিটামিনসমৃদ্ধ ভোজ্যতেলের প্রাপ্যতা নিশ্চিতের তাগিদ
খোলা ড্রামে তেল বিক্রি : মারাত্মক হুমকিতে শিশু ও গর্ভবতী নারীরা
দেশে ভোজ্যতেল ভিটামিন ‘এ’ ও ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণের আইন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে অধিকাংশ তেলে পর্যাপ্ত ভিটামিন নেই। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীদের জন্য এই ঘাটতি অন্ধত্ব এবং মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। খোলা ড্রামে তেল বিক্রি বন্ধ করা এবং গুণগত মানসম্পন্ন প্যাকেজিং বাধ্যতামূলক করা ছাড়া জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত এই সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়।
বুধবার (২৯ অক্টোবর) রাজধানীর বিএমএ ভবনে অনুষ্ঠিত ‘সবার জন্য ভিটামিন সমৃদ্ধ নিরাপদ ভোজ্যতেল : অগ্রগতি, বাধা ও করণীয়’ শীর্ষক সাংবাদিক কর্মশালায় এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়। কর্মশালায় প্রিন্ট, টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়ার ২৮ জন সাংবাদিক অংশ নেন। অনুষ্ঠানটি আয়োজ করে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ।
বিজ্ঞাপন
আলোচকরা জানান, দেশে ভোজ্যতেল ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধকরণের আইন থাকা সত্ত্বেও বাস্তবে অধিকাংশ তেল ভিটামিন ছাড়া অথবা পরিমিত মাত্রায় থাকে না।
আইসিডিডিআর,বি-এর গবেষণা অনুযায়ী, বাজারে বিক্রি হওয়া মোট ভোজ্যতেলের প্রায় ৬৫ শতাংশই ড্রামে বিক্রি হয়, যার মধ্যে ৫৯ শতাংশ তেলে কোনো ভিটামিন ‘এ’ নেই এবং মাত্র ৭ শতাংশ তেলে আইন অনুযায়ী পর্যাপ্ত ভিটামিন পাওয়া গেছে। ফলস্বরূপ, দেশে বিশেষত শিশুদের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’ -এর ঘাটতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
বক্তারা আরও বলেন, খোলা ড্রামগুলো অনেক সময় পূর্বে রাসায়নিক পদার্থ বা অন্যান্য শিল্পপণ্য সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা তেলকে দূষিত করে ও মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে। তাছাড়া এসব ড্রামে কোনো লেবেল বা উৎসের তথ্য না থাকায় তেলের উৎস শনাক্ত ও মান যাচাই করা সম্ভব হয় না। খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি জুলাই ২০২২ থেকে ও খোলা পাম তেল বিক্রি ডিসেম্বর ২০২২ থেকে নিষিদ্ধের সরকারি নির্দেশনা থাকলেও মাঠপর্যায়ে এর কার্যকর বাস্তবায়ন হয়নি।
এ অবস্থায়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বিএসটিআই, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে বাজারে ভিটামিনসমৃদ্ধ ও নিরাপদ তেল নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তারা।
কর্মশালায় আরও জানানো হয়, সাম্প্রতিক সময়ে ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি উদ্বেগজনক মাত্রায় পৌঁছেছে। তাই ভোজ্যতেলে ভিটামিন ‘এ’-এর পাশাপাশি ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধকরণ করা হলে একটি কার্যকর, স্বল্পব্যয়ী ও টেকসই জনস্বাস্থ্য উদ্যোগ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি, সূর্যালোক বা অতিরিক্ত আলোর সংস্পর্শে ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায় উল্লেখ করে তারা আলো প্রতিরোধী অস্বচ্ছ বোতলে তেল সংরক্ষণের পরামর্শ দেন। দেশে ভোজ্যতেল মোড়কজাতকরণে গুণগত প্যাকেজিংয়ের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে আলোচকরা মত দেন। ভিটামিন ‘এ’-এর ঘাটতির কারণে শিশুদের অন্ধত্ব এবং গর্ভবতী নারীদের মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। ভিটামিন ‘ডি’-এর অভাবে রিকেটস, হাড়ক্ষয় ও হৃদরোগসহ নানান অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।
এসময় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক (উপসচিব) ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন বলেন, দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষ বোতলের তেল খান না। খোলা তেলে কেমিক্যাল মেশানো হয় এবং এর জন্য দামও বাড়ানো হয়। এই মিশ্রিত কেমিক্যালগুলো থেকে ক্যান্সার, কিডনি এবং হার্টের সমস্যা হতে পারে। তেল পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ড্রাম থেকেও হাজার হাজার জীবাণু এবং মিলিয়ন মিলিয়ন মাইক্রোপ্লাস্টিক নির্গত হয়, যা শিশুদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি।
তিনি আরও বলেন, ভিটামিন এ ফর্টিফিকেশনের কারণে লিটার প্রতি তেলের দাম মাত্র ৫০ পয়সা বৃদ্ধি পায়, যা ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অতিরিক্ত দেখায়। খোলা তেলে ভিটামিনের মাত্রা ৩০ পিপিএম থেকে দ্রুত কমে ৫–৬ পিপিএম-এ নেমে আসে। ফলে ভোক্তা ন্যূনতম সুবিধাই পায়।
ফকির মুহাম্মদ মুনাওয়ার হোসেন সমাধানের পথ হিসেবে বলেন, ফুড-গ্রেড ড্রামের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে এবং খোলা তেল বিক্রি সম্পূর্ণ বন্ধ করা হলে জনস্বাস্থ্য রক্ষা সম্ভব। তিনি সাংবাদিকদেরও দায়িত্ব জানান, এই বিষয়গুলো জনগণের কাছে তুলে ধরে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান মুহ. ইফতিখার বলেন, ভিটামিন ‘ডি’-এর ঘাটতি শুধুমাত্র শিশু বা গর্ভবতী নারীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, আইন বাস্তবায়নের দায়িত্ব মূলত রিফাইনারিদের। সরকার শুধু নজর রাখে। ভোক্তাদেরও কণ্ঠস্বর তুলে ধরা জরুরি।
কর্মশালায় আরও বক্তব্য রাখেন বাংলা ট্রিবিউনের বিজনেস ইনচার্জ মো. শফিকুল ইসলাম, প্রজ্ঞার নির্বাহী পরিচালক এবিএম জুবায়ের, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম অফিসার ডা. আলিভা হক এবং প্রজ্ঞার কর্মসূচি প্রধান হাসান শাহরিয়ার।
টিআইি/এসএম