‘নার্স-মিডওয়াইফদের দক্ষতা বৃদ্ধি ছাড়া স্বাস্থ্যের উন্নয়ন অসম্ভব’
অনলাইন সভায় বক্তারা
বাংলাদেশের নার্সরা যথেষ্ট যোগ্যতাসম্পন্ন। বিদেশে তাদের চাহিদা থাকলেও পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাব রয়েছে। এ অবস্থায় নার্স এবং মিডওয়াইফদের পেশাগত ও সামাজিক উন্নয়ন ব্যতীত স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন দেশের নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি সেক্টরের বিশিষ্টজনরা।
রোববার (১৩ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরাম আয়োজিত এক অনলাইন সভায় বক্তারা এ মন্তব্য করেন। নিয়মিতভাবে আয়োজিত সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে এ পর্বের আলোচনার মূল বিষয় ছিল- ‘নার্সিং এবং মিডওয়াইফারির দক্ষতা বৃদ্ধি, বাংলাদেশ কি সঠিক পথে আছে?’।
বিজ্ঞাপন
বক্তারা বলেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নে আশু সরকারি-বেসরকারি নার্সিং কলেজ ইনস্টিটিউটগুলোকে শক্তিশালী করতে সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এগুলোর তদারকির দরকার রয়েছে। লজিস্টিক সাপোর্ট এবং ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়েরও দরকার। নার্সিং এবং মিডওয়াইফারির দক্ষতা বৃদ্ধি করতে শিক্ষকদের জন্য সুনির্দিষ্ট অরগানোগ্রাম প্রয়োজন।
উন্নত দেশসমূহে হাসপাতালের প্রশাসনিক দায়িত্বে নার্সরা থাকলেও বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তারা।
বিজ্ঞাপন
সভায় আলোচক অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন- নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব বেগম সিদ্দিকা আক্তার, বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিলের রেজিস্ট্রার সুরাইয়া বেগম এবং ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজের অধ্যক্ষ ড. মো. আনিসুর রহমান ফরাজী।
কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র হেলথ স্পেশালিস্ট এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার।
বক্তব্যের শুরুতে সুরাইয়া বেগম এরকম একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ড. জিয়া এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাথা যদি ডাক্তার হন, তাহলে হৃদয় হলেন নার্স। দেশে রেজিস্ট্রার্ড নার্সের সংখ্যা সবমিলিয়ে ৭১ হাজার, যেখানে চাহিদা রয়েছে ৩ লাখ। সুতরাং তাদের কাছ থেকে মানসম্পন্ন সেবা পাওয়ার আশা করা যায় না’।
তিনি বলেন, ‘নার্সরা বিদেশে গেলে কেউ তাদের অন্য দেশের নার্স থেকে আলাদা করতে পারে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেক নার্স বিদেশে গেলেও সরকারিভাবে বড় কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বাইরে থেকে অনেকে এখান থেকে নার্স নিতে এসেও ফিরে গেছেন।’
সুরাইয়া বেগম বলেন, ‘নার্সিং শিক্ষায় বিদ্যমান কারিকুলামের মান ভালো হলেও তা বাস্তবায়নের পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়নি। সকলের সহযোগিতা পেলে নার্সরা বিদেশে গিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারবেন। নার্সিং এডুকেশনে মাস্টার্স কোর্স চালু করতে সরকারি-বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে। এই কোর্স বিষয়ভিত্তিক হওয়ায় অনেক স্পেশালাইজড নার্স পাওয়া যাবে। উচ্চশিক্ষিত নার্সরা শিক্ষকতায় আসলে নার্সদের দক্ষতাও বাড়বে। স্পেশালাইজড নার্স থাকলেও পদ তৈরি না হওয়ায় তাদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না।’
সরকারি নার্সিং ইনস্টিটিউটগুলোকে ধীরে ধীরে কলেজে রূপান্তর করার পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে সিদ্দিকা আক্তার বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি সবার দক্ষতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে। আগে প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখন ওরিয়েন্টেশন ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। করোনার ওপরও প্রশিক্ষণ চালু হয়েছে। আশার কথা হলো- হলিক্রস, নটরডেম কলেজের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে এবং জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখে এখন এ পেশায় আসছেন।’
নার্সিং শিক্ষা এখনো গণমুখী হয়নি উল্লেখ করে ড. ফরাজী বলেন, ‘তবে এর অগ্রগতি আশানুরূপ। দেশে এখন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে এগুলো তদারকির প্রয়োজন রয়েছে। লজিস্টিক সাপোর্ট এবং ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়েরও দরকার। নার্সিং এবং মিডওয়াইফারির দক্ষতা বৃদ্ধি করতে শিক্ষকদের জন্য সুনির্দিষ্ট অরগানোগ্রাম প্রয়োজন। আর নার্সদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করতে হবে তাদের আন্তরিকতা এবং মানসম্পন্ন সেবা দানের মাধ্যমেই। ডাক্তারদের সঙ্গে নার্সরা একটি টিম হিসেবে পাশাপাশি কাজ করতে হবে। নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের নির্দেশনাকে স্থানীয় প্রশাসন যেন উপেক্ষা না করে সে বিষয়ে নজর দিতে হবে।’
কানাডা, আমেরিকা, ইউরোপের দেশগুলোতে হাসপাতালের প্রশাসনিক দায়িত্বে নার্সরা থাকেন, ডাক্তাররা নয়; সঞ্চালক ড. জিয়া বিষয়টির অবতারণা করলে সিদ্দিকা আক্তার জানান, তিনি আশাবাদী শিগগির বাংলাদেশের নার্সরা চাকরিতে প্রথম শ্রেণির মর্যাদাও পাবেন। করোনাকালে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই উচ্চঝুঁকি নিয়ে নার্সরা যেভাবে দিনরাত সেবা দিয়ে গেছেন তা প্রশংসার দাবিদার। ভালো শিক্ষক তৈরি করতে পারলে ভালো নার্স এমনিতেই বেরিয়ে আসবে। করোনাকালেও ৫০০ জন নার্স নিতে চেয়েছিল কুয়েত।
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ওপর গুরুত্বারোপ করে ড. ফরাজী বলেন, ‘শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না। দক্ষ নার্স এবং নার্স এডুকেটরদের একটি ট্রাস্ট প্রোগ্রামের আওতায় আনা যেতে পারে। তাহলে পিপিপি-র মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক নার্সকে স্পেশালাইজড ট্রেনিং, নার্সিং এডুকেশন ট্রেনিং দেয়ার পাশাপাশি অন্যান্য ঘাটতিও মেটানো যাবে। বেসরকারি ক্ষেত্রের চিকিৎসকদের মতো নার্সদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সুযোগ নেই। তাদের বেতনের ওপর নির্ভর করতে হয়। তাই জীবন নির্বাহ করাও দুরূহ হয়ে ওঠে। সেজন্য বেতন কাঠামোর কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
টিআই/এফআর