আমি ইউক্রেনীয়, নিজ ঘরের মালিক হতে চাওয়াই আমার অপরাধ
আমি একজন ইউক্রেনীয়। ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখ কিয়েভ সময় ভোর ৫টায় ঘুম থেকে জেগে যেন নতুন ইউক্রেন এবং নতুন বিশ্বকে দেখতে পেলাম। নতুন এই বিশ্বটি আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই বিশ্বে যেন আইন দিয়ে নয়, পারমাণবিক শক্তির জোরেই বেঁচে থাকতে হয়!
এই বিশ্বের মানচিত্রে ইউক্রেনের ভূখণ্ড স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। আর এই মানচিত্র জুড়েই লুহানস্ক থেকে ইভানো-ফ্রাংকিভস্ক, সামি থেকে খারকিভ, খেরসন থেকে কলোমিয়া এবং ক্রিভয়ি রিহ থেকে লুতস্ক পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে রাশিয়া।
বিজ্ঞাপন
আজ আমরা ভালোবাসা ও ঘৃণাকে সঙ্গে করেই ঐক্যবদ্ধ। স্বাধীনতার প্রতি ভালোবাসা এবং পুতিনের রাশিয়ার প্রতি ঘৃণা নিয়ে আমরা ঐক্যবদ্ধ। আমরা আমাদের নিজ ঘরের মালিক হতে চেয়েছিলাম। আর এটিই আমাদের একমাত্র ‘অপরাধ’।
বিজ্ঞাপন
আমরা নিজেরাই আমাদের পথ খুঁজে বের করতে চেয়েছিলাম, ভুল করতে ও সেই ভুল সংশোধনও করতে চেয়েছিলাম। আমরা আমাদের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশীর ভয় এবং সম্পর্কের জটিলতাকে বিবেচনা না করে নিজেরাই একটি ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চেয়েছিলাম।
গত ৮ বছর ধরে ইউক্রেন সেই দেশগুলোর ক্লাবে রয়েছে, যারা রাশিয়ার ‘ভ্রাতৃত্বপূর্ণ আলিঙ্গন’ পেয়েছে। ২৪ তারিখ ভোর পাঁচটার মধ্যেই এই আলিঙ্গন বিশ্রীভাবেই প্রকাশ হয়ে গেছে। আর এখন তো তাদের (রাশিয়ার) মুখোশই সরে গেছে।
অপশক্তি তাদের এতোদিনের অপ্রকাশিত শান্তির হাসি হেসেছে। অবশ্য শুধুমাত্র যারা দেখার এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছেন তারাই আজ ‘সবকিছু এখনও পরিষ্কার নয়’ বলতে পারেন।
আমাদের শহরগুলোতে যখন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আঘাত হানছিল তখন আর কী করার আছে? ব্রিটেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর ১৯৪০ সালের ৩ মে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের দেওয়া বক্তব্যকে স্মরণ করা যেতে পারে।
তিনি বলেছিলেন, ‘আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন- আমাদের রাজনৈতিক পথ কী? আমি উত্তর দেবো: সৃষ্টিকর্তা আমাদের যে শক্তি ও সক্ষমতা দিয়েছেন, তা দিয়ে জলে-স্থলে-আকাশে যুদ্ধ করা। সেই ভয়ানক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, যারা যেকোনো মানব অপরাধকে ছাড়িয়ে যায়। এটিই আমাদের রাজনৈতিক পথ।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারেন যে, আমাদের লক্ষ্য কী? আমি এক বাক্যে উত্তর দেবো: বিজয়, যেকোনো মূল্যে বিজয়, ভয় থাকা সত্ত্বেও বিজয়, পথ যতই দীর্ঘ এবং কঠিন হোক না কেন লক্ষ্য শুধুই বিজয়। কারণ বিজয় ছাড়া কোনো জীবন থাকবে না।’
২৪ তারিখ ভোর ৫টায় রাশিয়ার নিক্ষেপ করা মিসাইলগুলো ইউক্রেনের ভূখণ্ডতে পড়ার সাথে সাথে বিশ্বের একটি যুগ শেষ হয়ে গেছে। আজ সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেছে। এখন পরম সরলতা ও সততার সময়। স্বাধীনতা কখনোই দাসত্বে পরিণত হবে না।
রাশিয়া যে যুদ্ধ শুরু করেছে তা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। রাশিয়া যদি হাজার বারও এটিকে ‘বিশেষ অভিযান’, ‘নাৎসিবাদ নির্মূলের অভিযান’ এবং ‘শান্তি প্রক্রিয়ার অংশ’ বলে দাবি করে, তবুও এটি মানবতার বিরুদ্ধেই অপরাধ।
স্বৈরাচার ও গণতন্ত্রের মধ্যে কোনো মিল নেই। ইউক্রেনের এই পরিস্থিতিতেও পুরো বিশ্ব যদি এই বিষয়টি ভালোভাবে বুঝতে না পারে তাহলে এটি বিশ্বের জন্যই অনেক খারাপ।
...১৯৬৩ সালের ২৬ জুন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি পশ্চিম বার্লিনের শোনেবার্গ টাউন হলের সামনে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা ইতিহাসে ‘আই অ্যাম অ্যা বার্লিনার’ বা আমি বার্লিনের মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
প্রেসিডেন্ট পুতিনের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টারা বার্লিন প্রাচীর নির্মাণ করেছিলেন এবং এরপর থেকেই শহরের বাসিন্দারা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলেন। সেসময় শহরের মানুষের পাশে দাঁড়াতেই বার্লিনে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি।
বার্লিনে দেওয়া জন এফ কেনেডির ঐতিহাসিক সেই ভাষণের মাত্র কয়েকটি শব্দ আমরা পরিবর্তন করবো। আমেরিকান প্রেসিডেন্টের বক্তৃতা লেখকরা আমাদেরকে ক্ষমা করুন।
এখানে সেই ভাষণের একটি অংশ তুলে ধরছি যা আপাতদৃষ্টিতে আজ এবং বিশেষভাবে আমাদের (ইউক্রেনের) জন্যই লেখা। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে চলে আসা একটি প্রবাদ হচ্ছে- ‘আমি রোমের নাগরিক’। আর, এই মুক্ত বিশ্বে এটি এভাবেই শোনা উচিত যে - ‘আমি একজন ইউক্রেনীয়’।
বিশ্বে এমন বহু মানুষ আছে যারা মুক্ত বিশ্ব এবং রাশিয়ার মধ্যে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা ঠিক কী সেটা বোঝে না বা দাবি করে যে, তারা বোঝে না। এবার (ইউক্রেনের রাজধানী) কিয়েভে আসুন।
এখানে অনেকেই আছেন, যারা পুতিনের রাশিয়াকেই তাদের ভবিষ্যৎ বলে উল্লেখ করে থাকেন। এখানে এমনও অনেকে আছেন, যারা বলেন- ইউরোপে এবং অন্য কোথাও আমরা রাশিয়াকে সহযোগিতা করতে পারি।
আবার এখানে এমন মানুষও আছেন, যারা বলেন- পুতিনের রাশিয়া একটি অশুভ ব্যবস্থা। কিন্তু এই মনোভাব অর্থনৈতিকভাবে তাদের সাথে সহযোগিতামূলক আচরণ করতে বাধা দেয় না।
মুক্ত সকল মানুষ (দেশের) যেখানেই বসবাস করুক না কেন, তারা ইউক্রেনের নাগরিক। অতএব, একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে আমি গর্ব করে বলতে পারি: ‘আমি ইউক্রেনীয়!’
ইউক্রেনের সংবাদমাধ্যম প্রাভডা’র সম্পাদকীয় থেকে অনুদিত।
টিএম