বেওয়ারিশ লাশ পেলেই ছুটে যান ‘শরিফ চাচা’
তিন জায়গায় তার বিচরণ— থানা, হাসপাতাল আর মর্গে। বেওয়ারিশ দেহ পেলেই সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন। শরিফ চাচা নামে পরিচিত তিনি।
মরদেহ পুরুষের না নারীর— তা নিয়ে শরিফ চাচার মাথাব্যথা নেই। পচা, গলে যাওয়া, ক্ষতবিক্ষত, মুণ্ডহীন, বিকৃত, রাইগর মর্টিস ধরে যাওয়া এমনকি রক্তাক্ত পোশাকে মোড়া দেহও তিনি নেন। পরম মমতায় তাদের ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করেন। পাল্টে দেন পোশাকও।
বিজ্ঞাপন
শরিফ চাচা মরদেহগুলো যত্ন করে শুইয়ে দেন শেষশয্যায়। কারও মাটির নিচে কারও বা কাঠের চিতায় ‘বিছানা’ পাতেন তিনি। বেওয়ারিশ দেহগুলোর মাটি পায় শরিফের জন্যই। এ পর্যন্ত ৩০০০-এরও বেশি হিন্দু দেহ সৎকার করেছেন। কবর দিয়েছেন আড়াই হাজার মুসলিমকে।
ভারতের ফৈজাবাদে বাড়ি শরিফের। সবাই শরিফ চাচা নামেই ডাকেন। শরিফের ‘শরিফি’ নজরে পড়েছে ভারত সরকারেরও। ২০২০ সালে তাকে পদ্মশ্রী সম্মান দিয়েছে ভারত সরকার। কিন্তু শরিফ কোনো পুরস্কারের আশায় এই কাজ করেননি। করেন না।
বিজ্ঞাপন
২৭ বছর ধরে ভাগাড় ঘেঁটে একের পর এক দেহ তুলে এনেছেন। নিজে সম্মান পাবেন বলে নয়। তার ভাবনা ছিল একটাই, মৃত্যুর পর বেওয়ারিশ দেহগুলোর যাতে কোনো অসম্মান না হয়।
এক সময় সাইকেল মেরামতের কাজ করতেন শরিফ। বড় ছেলে মোহাম্মদ রইস খান যখন বাবার ব্যবসায় না এসে সুলতানপুরে কেমিস্টের কাজ করতে চাইলেন, তখন আপত্তি করেননি শরিফ। কিন্তু সেই ছেলে আর ফেরেনি।
বেশ কয়েক সপ্তাহ ছেলের খবর না পেয়ে তাকে খুঁজতে সুলতানপুরে যান শরিফ। প্রায় এক মাস ধরে দরজায় দরজায় ঘুরে ছেলেকে খুঁজে পান রেললাইনের ধারে। রইসের শরীর একটি বস্তায় মোড়া ছিল। তার অনেকটাই খুবলে খাওয়া।
শরিফ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ওই দৃশ্য জীবনে ভুলতে পারব না। উন্মাদ মনে হচ্ছিল নিজেকে। কিন্তু সে দিনই ঠিক করি আর কারও সন্তানের এই পরিণতি হতে দেব না।’
শরিফ মনে করেন, মৃত্যুর পরও সম্মান জরুরি। মৃত্যুতেও শালীনতা থাকা দরকার। সেই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু তার।
এক সময়ে একাই সব কাজ করতেন। এখন বয়স ৮২। কয়েকজন রিকশাচালক আর নিজের নাতির সাহায্যে এখনও তিনি লক্ষ্যে অবিচল।
শরিফের কথা এখন অনেকেই জানেন। তাই কোনো দেহ ৭২ ঘণ্টা বেওয়ারিশ পড়ে থাকলে পুলিশই খবর দেয় তাকে।
এক একটি দেহ সৎকার করতে খরচ পড়ে ৩০০০-৫০০০ টাকা। সে টাকা কোথা থেকে আসে? সাইকেল মেরামতের দোকান আর নেই শরিফের। ১৫ জনের পরিবারের খাবার জোগান দেন একমাত্র নাতি, যিনি একজন তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী। তবে খরচ জোগাড় হয়েই যায়।
শরিফের নাতি সাবির জানান, অনেকেই তাদের কাজ দেখে অর্থ সাহায্য করেন, তা দিয়েই সৎকারের কাজ করেন তারা। তবে সাবির এও বলেছেন যে, এই অসুবিধার মধ্যে কাজ করতে গিয়েই আরও বেশি করে অনুপ্রেরণা পান তারা। যা তারা আগামী দিনেও চালিয়ে যাবেন।
এসএসএইচ