নারী নিপীড়ক পুরুষদের মানসিক চিকিৎসায় পাঠাচ্ছে ইকুয়েডর
ছবি: এনডিটিভি
ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটোর এক এলাকার একটি হলঘরে বসে আছেন বিভিন্ন বয়সী পুরুষদের একটি দল। সেখানে তারা একসঙ্গে দুই হাত ওপরে তুলছেন, গভীর নিঃশ্বাস নিচ্ছেন, কিছুক্ষণ পর ‘আহ’ শব্দে সেই নিঃশ্বাস ছাড়ছেন।
যোগ ব্যায়ামের ক্লাস চলছে সেই হলঘরে; তবে যেসব পুরুষরা এই ক্লাসে ছাত্র বা প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন, তারা কেউই সাধারণ আটপৌরে মানুষ নন, প্রত্যেকেই নারী নির্যাতন ও পারিবারিক নির্যাতনের আসামি হিসেবে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এবং আদালতের আদেশে এসেছেন এখানে।
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ইকুয়েডরে নারী নির্যাতন রীতিমতো ভয়াবহ রূপ নেওয়ায় অপরাধীদের একাংশকে মানসিক চিকিৎসা দেওয়ার পদক্ষেপ নিয়েছে ইকুয়েডর সরকারের বিচারবিভাগ। এক্ষেত্রে হত্যা করেননি, কিন্তু নারী নির্যাতনের দায়ে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
কোনো অপরাধী যদি মানসিক চিকিৎসা নিতে না চান, সেক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে তার জন্য কারাবাসের সাজা রেখেছে ইকুয়েডরের সরকার।
বিজ্ঞাপন
এই চিকিৎসাকেন্দ্রের নাম দেওয়া হয়েছে মেন’জ ক্লাব। সম্প্রতি এই ক্লাবে চিকিৎসা নিতে আসা কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি জর্জ সানচেজের সঙ্গে কথা হয় এএফপির। নিজের প্রেমিকাকে নির্যাতনের অভিযোগে কারাবাসের সাজা পেয়েছেন তিনি।
তবে রায় ঘোষণার সময়ে আদালত বলেছেন, সানচেজ যদি মেন’জ ক্লাবের কোর্স করা ও ৬০ ঘণ্টা সামাজিক সেবামূলক কাজের (কমিউনিটি সার্ভিস) সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাহলে তার কারাদণ্ড মওকুফ করা হবে।
এএফপিকে জর্জ সানচেজ জানান, ক্লাবে আসা প্রত্যেক সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের ২০ দিনের একটি কোর্স করানো হয়। সপ্তাহে একদিন হয় কোর্সের ক্লাস, দৈর্ঘ্য থাকে তিন ঘণ্টা।
কোর্সের শুরুতে খানিকটা সময় শারীরিক অনুশীলন করেন শিক্ষার্থীরা, তারপর বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে নিজেদের দোষত্রুটি, গুণ ও ভয়-ভীতি সম্পর্কে খোলাখুলি আলোচনা করেন।
বর্তমানে যে শিক্ষার্থী দলটিতে সানচেজ রয়েছেন, সেখানকার সবার বয়স ৩০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে। তারা সবাই পেশাজীবী। সরকারি-বেসরকারি অফিসের কেরানি থেকে শুরু করে কারখানা শ্রমিকও রয়েছেন দলটিতে।
এএফপিকে সানচেজ বলেন, ‘আমি আমার ক্রোধে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতাম না; এবং যখন ক্ষুব্ধ থাকতাম, রীতিমতো ফেটে পড়তাম। নিজের ওপর তখন কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকত না আমার।’
‘কিন্তু এই কোর্স করার পর থেকে নিজের মধ্যে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। এখন আর আগের মতো আমি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়ি না।’
‘আমার সাবেক প্রেমিকার সঙ্গে যেসব নিষ্ঠুর আচরণ করেছি, সেজন্যও আমি অনুপতপ্ত।’
ইউরোপ, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার ৩৮টি দেশের আন্তসরকার সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো অপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্টের (ওইসিডি) তথ্য অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে গত কয়েক বছরে নারীর প্রতি সহিংসতাজনিত অপরাধের হার বেড়েছে ২৭ শতাংশ।
বর্তমানে এই দুই অঞ্চলের যেসব দেশ নারী নির্যাতনের হার সবচেয়ে বেশি সেসবের মধ্যে ইকুয়েডর অন্যতম। দেশটির প্রধান আইন কর্মকর্তার কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালের মে থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত ৬ বছরে ইকুয়েডরে ১ হাজার ৪৩২ জন নারী নিহত হয়েছেন, সহিংস আচরণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আরও কয়েক হাজার নারী।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত্যা কিংবা সহিংসতার দায়ী তাদের স্বামী অথবা প্রেমিকরা।
ইকুয়েডরের বিভিন্ন নারী অধিকার সংগঠন অবশ্য বলেছে, দেশটিতে নির্যাতন ও হত্যার শিকার নারীদের সংখ্যা অনেক বেশি।
ইকুয়েডরের পুলিশ জানিয়েছে, ২০২০ সালে সারা দেশ থেকে নারী নির্যাতন বিষয়ক ১ লাখ ১৩ হাজার ৪০০টি ফোনকল রিসিভ করেছেন তারা। ২০২১ সালে এই সংখ্যা ছিল আরও বেশি— ১ লাখ ১৭ হাজার ৪০০।
এ পরিস্থিতিতে নারীর প্রতি সহিংস মনোভাব দূর করতে এই অভিনব পন্থা নিয়েছে ইকুয়েডরের সরকার।
যে মেন’জ ক্লাবে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০১০ সালে। ক্লাবের কো অর্ডিনেটর রবের্তো মনকায়ো এএফপিকে জানান, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫৪৫ জনকে মানসিক চিকিৎসা দিয়েছে এই ক্লাব এবং ক্লাবের কোর্স শেষ করার পর কোনো শিক্ষার্থী পুনরায় নারীনিপীড়ণ করেছেন, এমন কোনো রেকর্ড এখন পর্যন্ত নেই।
মনকায়ো বলেন, ‘আমাদের পদ্ধতি হলো— চিন্তা করো, অনুভব করো এবং তারপর কাজ করো।’
‘আমরা যদি পরিবার, কর্মক্ষেত্র, সমাজে পুরুষ হিসেবে নিজের ভূমিকা পালনের সময় সহিংসতা, আগ্রাসন ও নিষ্ঠুর চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারি, তাহলে অনেকাংশে নারী নির্যাতন হ্রাস পাওয়া সম্ভব। যেসব কৌশল অবলম্বন করলে এসব মনোভাব থেকে দূরে থাকা যায়, এখানে আসা শিক্ষার্থীদের সেসব শেখানো হয়।’
এসএমডব্লিউ