একটি অনুন্নত, স্থলবেষ্টিত দেশ হিসেবে আফগানিস্তান বর্তমানে যে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে—সেজন্য দেশটির ভৌগলিক অবস্থা যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী নিকটতম প্রতিবেশী পাকিস্তানের ওপর দেশটির অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা।

আফগানিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আফগান ডায়াসপোরা নেটওয়ার্কের সাংবাদিক হামিদ পাকতিন সম্প্রতি এক কলামে পাকিস্তানের অর্থনীতির বর্তমান অবস্থার ভিত্তিতে একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করেছেন।

কলামে তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে পাকিস্তানের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে অভ্যস্ত আফগানিস্তান। এই অভ্যস্ততা ঐতিহাসিক এবং দশকের পর দশক ধরে নির্ভরশীলতার ফলে বর্তমানে নিত্য নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তালেবান শাসনাধীন বর্তমান আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে।

পাকিস্তানের দুর্দশা

হামিদ পাকতিনের মতে, পাকিস্তানের অর্থনীতি যে প্রতিদিন ক্ষয় হচ্ছে, তা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। ইতোমধ্যে দেশটিতে প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ২৪৮ দশমিক ৭৪ রুপি এবং প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ২৭৬ দশমিক ৫৪ রুপিতে পৌঁছেছে। এবং বর্তমানে যে বৈশ্বিক পরিস্থিতি, তাতে অদূর ভবিষ্যতে দেশটিতে জ্বালানির দাম আরও বাড়ার সম্ভাবনাই বেশি।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশি মুদ্রার মজুত কমে যাওয়া ও তার প্রভাবে লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকা মুদ্রাস্ফীতির মতো সংকটও চেপে বসেছে পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর। দেশটিতে বর্তমানে ডলারের মজুত রয়েছে ৯০০ কোটিরও কম। তার মধ্যে চলতি বছর পাকিস্তানকে বিদেশি ‍ঋণের কিস্তি বাবদ পরিশোধ করতে হবে ৪৮৭ কোটি ডলার। সেক্ষেত্রে, ঋণের কিস্তির অর্থ বাদ দিলে পাকিস্তানে বর্তমান রিজার্ভ রয়েছে মাত্র সাড়ে ৩ শ’ কোটি ডলারের কিছু বেশি।

ডলারের মজুত কমতে থাকায় দেশটিতে প্রতিদিনই বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি। ইতোমধ্যে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির দরপতন অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলেছে। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে ৩৩ শতাংশ কমেছে রুপির মান এবং বর্তমানে পাকিস্তানে প্রতি ১ ডলারের বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ২১৬ রুপি। ডলার বাঁচাতে ইতোমধ্যে আমদানিকারকদের জন্য এলসি হিসাব খোলা বন্ধ রেখেছে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংক।

পাকিস্তানের বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ বলছে— বর্তমানে যে গতিতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে, তা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসের মধ্যে পাকিস্তানে মুদ্রাস্ফীতির হার পৌঁছাবে ২৫ শতাংশে। সরকারি কর্মকর্তাদের অবশ্য ধারণা, আগামী বছর সম্ভাব্য মুদ্রাস্ফীতির হার সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ হতে পারে।

তবে বেসরকারি অর্থনীতিবিদরা সতর্কবার্তা দিয়ে জানিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতা আছে। মুদ্রাস্ফীতি যদি এই হার অতিক্রম করে, সেক্ষেত্রে রীতিমতো বিপর্যয় শুরু হবে দেশটির অর্থনীতিতে।

অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা যুক্ত হয়ে আরও জটিল করে তুলেছে পাকিস্তানের সার্বিক পরিস্থিতি। জ্বালানি তেলের দাম দিন দিন বাড়তে থাকায় পাকিস্তানের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো উৎপাদন কমাতে বাধ্য হয়েছে। ফলে দেশজুড়ে বিদ্যুৎবিভ্রাট এখন নিয়মিত ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। প্রত্যন্ত বিভিন্ন এলাকা দিনে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকছে।

বাড়তে থাকা এই বিদ্যুৎবিভ্রাটের প্রভাব পড়ছে দেশটির শিল্পোৎপাদন, বাণিজ্য ও রপ্তানি খাতে। সাধারণ পাকিস্তানিদের হতাশা-ক্ষোভও বাড়ছে দিন দিন। এদিকে, এ পরিস্থিতি থেকে দেশটিকে উদ্ধার করতে ইসলামাবাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিতি বিভিন্ন দেশের মধ্যেও তেমন আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ডোনাল্ড লু সম্প্রতি দেশটির আইনসভা কংগ্রেসের একটি কমিটিকে বলেছেন, পাকিস্তানের সামনে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে।

আফগানিস্তানকে ব্যবহার করছে পাকিস্তান

হামিদ পাকতিন তার কলামে দাবি করেন, নিজেদের অর্থনীতির পতন ঠেকাতে এখন আফগানিস্তানের সংকটকে ব্যবহার করছে পাকিস্তান। তিনি বলেন, আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লাল তালিকায় থাকার কারণে দেশটি থেকে ইতোমধ্যে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে অধিকাংশ রাষ্ট্র। 

তালেবানগোষ্ঠীর প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এই বৈরী মনোভাবেরই সুযোগ পাকিস্তানের সরকার নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন হামিদ। তার মতে, নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় প্রতিটি পণ্যের জন্য পাকিস্তানের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল আফগানিস্তানে যেন রপ্তানি আরও বাড়ানো যায়, সেজন্য সচেতনভাবে কাজ করছে ইসলামাবাদ।  

‘অঘোষিত বিভিন্ন নীতি গ্রহণের মাধ্যমে আফগানিস্তানকে যেন পাকিস্তানের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল করা যায়, সেজন্য আফগান ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সুবিধা দিচ্ছে ইসলামাবাদ,’ কলামে বলেন হামিদ পাকতিন।

আফগানিস্তানের আর একটি বড় দুর্বলতা দেশটির স্থলবেষ্টিত ভৌগলিক অবস্থা। ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য পাকিস্তানের করাচি সমুদ্রবন্দরের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল আফগানিস্তানকে প্রতি বছর এই বন্দর বাবদ মোটা অঙ্কের ভাড়া গুণতে হচ্ছে। তাছাড়া বন্দরের প্রশাসনিক জটিলতার কারণে নানা ভোগান্তিতে পড়তে হয় আফগান আমদানিকারকদের।

ইতোমধ্যে পাকিস্তান বেলুচিস্তান প্রদেশের অপর সমুদ্রবন্দর গাওদা ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে আফগানিস্তানকে। তবে বেলুচিস্তানের যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সেখানকার বন্দরের যে অবকাঠামোগত বিভিন্ন সমস্যা, তাতে সেই বন্দর ব্যবহার করা আফগানিস্তানের জন্য খুব লাভজনক হবে না।

নতুন বিকল্প ইরান?

সাংবাদিক হামিদ পাকতিনের মতে, পাকিস্তানের বর্তমান এই শোষন থেকে বাঁচতে ইরান একটি ভালো বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। ইতোমধ্যে তেহরান কাবুলকে ইরানের চাবাহার সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রস্তাব আফগানিস্তানের জন্য লাভজনক হতে পারে তিনভাবে ভাবে; প্রথমত চাবাহার সমুদ্র বন্দরটি করাচির তুলনায় অনেক নিকটবর্তী। বন্দরটি কাছেই আফগানিস্তানের জাবুল প্রদেশ। ফলে আমদানি করা পণ্য দেশের ভেতরে পরিবহন বাবদ খরচ কমে আফগানিস্তানের।

দ্বিতীয়ত, ইরানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে— প্রতিবেশী আফগান ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারের ভাড়া ও পণ্য পরিবহন বাবদ কিছু অর্থ ছাড় দেওয়া হবে। আরও বলা হয়েছে, বন্দরে পণ্য রাখার জন্য বাড়তি কোনো অর্থ গুণতে হবে না আফগান ব্যবসায়ীদের। অর্থাৎ, করাচির বদলে এই বন্দরটি ব্যবহার করা হলে আফগানিস্তানের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থও বেঁচে যাচ্ছে।

তৃতীয়ত, মূলত ভৌগলিক দুর্বলতাকে ব্যবহার করে পাকিস্তান দশকের পর দশক ধরে আফগানিস্তানের কাছ থেকে যেসব অন্যায্য সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে, সেই শোষন থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তেহরানের এই প্রস্তাবের মধ্যে দিয়ে।

কলামের শেষ পর্যায়ে হামিদ পাকতিন বলেন, ‘একজন বিপদগ্রস্ত প্রতিবেশী কখনও আপনাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসবে না। দশকের পর দশক ধরে কারো ওপর নির্ভরশীল থাকাও কোনো কাজের কথা নয়। দিনের শেষে আফগানিস্তানকে নিজের ভালো নিজের বুঝতে হবে।’

এসএমডব্লিউ