সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স ও দেশটির প্রকৃত নেতা মোহাম্মদ বিন সালমান নির্বাসিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে ‘হত্যার অনুমোদন’ দিয়েছিলেন বলে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত শুক্রবার ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপরই সৌদি যুবরাজ সালমানকে জবাবদিহিতায় বাধ্য করার ব্যাপারে দাবি উঠেছে সারা বিশ্ব থেকে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতীয়মান হয়েছে যে, খাসোগিকে আটক বা হত্যা করতে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে অভিযান চালানোর অনুমোদন দেন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।’

যা বলছে সৌদি আরব:

যুক্তরাষ্ট্রের এই গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে সৌদি আরব। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সৌদি প্রেস এজেন্সিকে দেওয়া বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদনকে ‘নেতিবাচক, মিথ্যা ও অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবেও অভিহিত করা হয়েছে।

সৌদি মন্ত্রণালয়ের দাবি, ‘সৌদি নেতৃত্ব সম্পর্কে ওই প্রতিবেদনে তুলে ধরা নেতিবাচক, মিথ্যা ও অগ্রহণযোগ্য মূল্যায়ন সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করছে সৌদি আরব এবং প্রতিবেদনে ভুল তথ্য ও ভুল উপসংহার টানা হয়েছে।’

তবে খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য, ‘এটা ছিল একটা ঘৃণ্য অপরাধ এবং এতে রাজতন্ত্রের আইন ও মূল্যবোধগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হয়েছে। নিজ নিজ সংস্থার নিয়ম ভেঙে ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অগোচরে একদল ব্যক্তি এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এছাড়া ওই অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দেশের আদালত ইতোমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করেছে। খাশোগির পরিবারও এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে।’

সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই):
দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তাসংস্থা ওয়াম’র বরাত দিয়ে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, খাশোগি হত্যাকাণ্ড নিয়ে মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়ে সৌদি আরবের পাশে দাঁড়িয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)।

এছাড়া সৌদি আরবের বিচার ব্যবস্থার প্রতি সমর্থন ও বিশ্বাসের কথা জানিয়েছে আমিরাতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে সৌদি আরব স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং নিরপেক্ষভাবে আইন বাস্তবায়নের কাজে অঙ্গীকারাবদ্ধ বলেও জানিয়েছে দেশটি।

যুক্তরাজ্য:
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বরাবরই জানিয়েছে, সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড যে জঘন্য অপরাধ এটা যুক্তরাজ্য সবসময়ই পরিষ্কার করে বলে এসেছে।

এক বিবৃতিতে দেশটি জানিয়েছে, ‘হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করতে আমরা আগেই আহ্বান জানিয়েছিলাম এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িত ২০ নাগরিকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।’

‘এছাড়া গত বছর রিয়াদ সফরের সময় ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীও এই বিষয়টি তাদের সামনে তুলেছিলেন। এ বিষয়ে আমরা সৌদি আরবের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি।’

পাকিস্তান:
সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে হত্যার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে পাকিস্তান ‘নোট নিয়েছে’ বলে উল্লেখ করেছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া সৌদি সরকার খাশোগির হত্যাকে ‘জঘন্য অপরাধ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে বলেও জানিয়েছে দেশটি।

এক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘খাশোগি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত, রায় ও সাজা বাস্তবায়নের ব্যাপারে সৌদি সরকার সম্ভব সকল আইনগত উদ্যোগই গ্রহণ করেছে। দেশটির এই প্রচেষ্টাকে পাকিস্তান সমর্থন করে এবং সৌদি আরবের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে।’

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক তদন্তকারী অ্যাগনেস ক্যালামার্ড
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদন প্রকাশের পর ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে অ্যাগনেস ক্যালামার্ড বলেছেন, (খাশোগি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের) জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের কাজে যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দেওয়া উচিত।

তিনি বলেন, ‘মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সৌদি আরবের শীর্ষ ব্যক্তিদের অপরাধ সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আর তাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে এবং ভবিষ্যতে এধরনের কোনো ঘটনা যেন আর না ঘটে সে ব্যাপারে কাজ করতে যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্সের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা।’

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি
সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্মূল্যায়ন  করতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ও প্রবীণ ডেমোক্র্যাট নেতা ন্যান্সি পেলোসি।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে নেওয়া সকল সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পাশে দাঁড়াবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস। একইসঙ্গে সৌদি আরবকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে নেওয়া সকল পদক্ষেপকেও আমরা সমর্থন করবো।’

মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের সিইও
ওয়াশিংটন পোস্টের প্রকাশক ও সিইও ফ্রেড রিয়ান বলেছেন, ‘নিরাপরাধ সাংবাদিক জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার দিন থেকেই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। একটি হচ্ছে- সত্য সামনে তুলে ধরতে হবে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে- হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট প্রকাশের মাধ্যমে সত্য প্রকাশিত হয়েছে। এখন, যে লোকটা এই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর অনুমোদন দিয়েছিলেন; তাকে অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

উল্লেখ্য, মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্টের কলাম লেখক ছিলেন সাংবাদিক জামাল খাশোগি। ২০১৮ সালে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে দেশটির এজেন্টদের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তিনি। নিজের বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তুলতে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। ৫৯ বছর বয়সী এই সাংবাদিক ছিলেন সৌদি সরকারের বিভিন্ন নীতি ও রাজপরিবারের কঠোর সমালোচক।

সূত্র: আলজাজিরা

টিএম