ইউনেস্কোর রিপোর্ট
ধারের টাকায় সন্তানকে পলিটেকনিকে পড়াচ্ছে এক-তৃতীয়াংশ পরিবার
ফাইল ছবি
ধারের টাকায় সন্তানকে প্রাইভেট পলিটেকনিকে পড়াচ্ছে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ পরিবার। এছাড়া বাংলাদেশে বেসরকারি শিক্ষায় বেড়েছে খরচও। অন্যদিকে বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় বেসরকারি শিক্ষা সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে।
এমনকি বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে বেশি জড়িত। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর প্রকাশিত নতুন এক গবেষণা রিপোর্টে এই তথ্য সামনে এসেছে। মঙ্গলবার (১ নভেম্বর) এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হয়।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় বেসরকারি শিক্ষা সবচেয়ে দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এই অঞ্চলে শেখার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ধীর গতিতে। আর তাই ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে সকল স্কুলে শিক্ষার গুণগত মান এবং সমতার দিকে আরও বেশি নজর দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
মঙ্গলবার প্রকাশিত ইউনেস্কোর ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি সংশ্লিষ্ট। এছাড়া উচ্চ প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার চাপ এবং সরকারি স্কুলগুলোর প্রতি অসন্তোষ অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বেশি শিক্ষার্থী ভর্তিকে ত্বরান্বিত করেছে। এর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক প্রাইভেট টিউটরিং এবং শিক্ষা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
বিজ্ঞাপন
দক্ষিণ এশিয়ায় বিগত কয়েক দশকে অন্য যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় শিক্ষার সুযোগ দ্রুত বৃদ্ধি পেলেও শিক্ষার মাত্রা বৈশ্বিক গড় থেকে এক তৃতীয়াংশেরও কম এবং বাকি বিশ্বের তুলনায় ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি সকল শিক্ষা কার্যক্রমকে একটি ব্যবস্থার অংশ হিসাবে দেখতে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করে শিক্ষার গুণমান এবং সমতা উন্নত করতেও রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে।
ইউনেস্কোর গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট এবং ব্র্যাক-সহ ছয়টি আঞ্চলিক অংশীদারের উদ্যোগে হওয়া এই গবেষণায় বেসরকারিখাতে পরিচালিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নজরদারি করতেও সরকারের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। মূলত শিক্ষা নিয়ে বৈষম্য দূর করতেই এই সুপারিশ করা হয়েছে।
আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, নেপাল, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করে এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, বেসরকারি শিক্ষার ক্রমবর্ধমান আবির্ভাব সমতাকে চাপের মধ্যে ফেলেছে। তবে এটি এক অর্থে ইতিবাচক যে, শিক্ষাখাতে সংশ্লিষ্ট সকল প্রভাবশালীর মধ্যে এটি সমন্বয় তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক মদতপুষ্ট ব্যক্তিরা এই অঞ্চলে শিক্ষার সকল স্তরে প্রভাবশালী। শৈশবকালে বেসরকারি খাত প্রায়শই শিক্ষা প্রদানকারী প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইরানের ৯৩ শতাংশ শিশুকে শিক্ষা দেয় বেসরকারি খাতের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাইভেট স্কুলগুলো নেপালে এক-চতুর্থাংশ, পাকিস্তানে এক তৃতীয়াংশ এবং ভারতে প্রায় অর্ধেক ছাত্রকে শিক্ষা দিয়ে থাকে। এই অঞ্চলে স্বল্প পারিশ্রমিকের প্রাইভেট স্কুলের বিকাশও ঘটেছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারতে স্থাপিত প্রতি ১০টি নতুন বিদ্যালয়ের মধ্যে ৭টি বেসরকারি বিদ্যালয়।
বাংলাদেশে প্রাথমিক ও প্রায় সব মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তার এক-চতুর্থাংশ যায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। ইংরেজি-ভাষা শিক্ষার চাহিদার কারণে আন্তর্জাতিক স্কুলগুলো স্থানীয়ভাবে প্রসার লাভ করেছে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় এই ধরনের স্কুল কার্যকরভাবে দ্বিগুণ হয়েছে।
ইউনেস্কোর ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শ্রম বাজারের কারণে ব্যক্তিগত টিউটরিং বা শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানোর হারও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই বিষয়টি পরিবারের ওপর সৃষ্টি করেছে আর্থিক চাপ।
এতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের পরিবারগুলোতে প্রাইভেট পড়ানোতে খরচ ২০০০ সালে ২৮ শতাংশে থাকলেও ২০১০ সালের মধ্যে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪ শতাংশ হয়েছে। আর শহরাঞ্চলে এই খরচ ২০০০-২০১০ সালের মধ্যে ৪৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৬৭ শতাংশ হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের প্রাক প্রাথমিক পর্যায়ের ২০ শতাংশ শিশুর প্রাইভেট পড়ানোর টিউটর রয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এছাড়া শ্রীলঙ্কায় ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ব্যক্তিগত শিক্ষাদানে পরিবারের ব্যয় ৪১ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬৫ শতাংশ এবং গ্রামীণ পরিবারের ব্যয় ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬২ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ব্যক্তিগত শিক্ষাদানের এই জনপ্রিয়তা কোচিং সেন্টারের উত্থানকে আরও ত্বরান্বিত করেছে; এমনকি ভারতে কোচিং সেন্টারের সংখ্যা কয়েক লাখ হতে পারে বলে রিপোর্টে জানিয়েছে জাতিসংঘ।
গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্টের পরিচালক মানোস আন্তোনিনিস বলেন, ‘শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরির একক কোনও উপায় নেই। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা শিক্ষাখাতে সৃষ্ট শূন্যস্থান পূরণ করতে না আসলে এই মুহূর্তে লাখ লাখ শিশুর কোনও শিক্ষাই থাকত না। কিন্তু এখানে একটা নজরদারির ব্যবস্থা করা উচিত যাতে শিক্ষার এই ভারসাম্য মুনাফা তৈরিতে এবং ব্যবসায়িক স্বার্থের দিকে না যায়; একইসঙ্গে সন্তানদের স্বার্থ যেন অক্ষুন্ণ থাকে।’
বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর পরিবার তাদের মোট খরচের সবচেয়ে বড় অংশ শিক্ষায় ব্যয় করে থাকে। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার পরিবারগুলো একক খাত হিসেবে শিক্ষাখাতে সবচেয়ে বেশি ৩৮ শতাংশ খরচ করে থাকে। বাংলাদেশে এই হার ৭১ শতাংশ, পাকিস্তানে ৫৭ শতাংশ এবং নেপালে ৫০ শতাংশ।
২০১৭-১৮ সালে ভারতে বেসরকারি স্কুলে পড়া প্রতি ছাত্রের গড় পারিবারিক খরচ সরকারি স্কুলে পড়া একজন ছাত্রের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি ছিল। তবে একই সময়সীমায় ১৩ শতাংশ পরিবার সঞ্চয় করেছে এবং আরও ৮ শতাংশ পরিবারকে স্কুলের ফি পরিশোধের জন্য অর্থ ধার নিতে হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে প্রায় এক তৃতীয়াংশ পরিবার তাদের সন্তানদের প্রাইভেট পলিটেকনিকে পড়ানোর জন্য টাকা ধার করে।
আন্তোনিনিস বলছেন: ‘এই অঞ্চলে বেসরকারি শিক্ষার বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হলো দক্ষিণ এশিয়ার সরকারগুলো শিক্ষাখাতে প্রস্তাবিত ১৫ শতাংশ ব্যয়ের চেয়ে অনেক কম খরচ করে। শিক্ষার মতো অধিকার সাধারণত বিনামূল্যে পাওয়ার কথা থাকলেও এই পরিস্থিতি অনেক পরিবারকে উচ্চ ব্যয়ের চাপে ফেলে দেয়।’
তার ভাষায়, ‘আমরা আশা করি, আমরা কীভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে গড়ে তুলছি এবং কোন বিষয়গুলো বাদ যাচ্ছে তা প্রতিফলনের জন্য জরুরি আহ্বান হিসাবে কাজ করবে এই প্রতিবেদনটি।’
টিএম