ঈদুল আজহাকে ঘিরে ক্রমশ জমে উঠছে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির পশুবাজার। কেমন সেই বাজার, কত দামে বিক্রি হচ্ছে পশু প্রভৃতি তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন করেছে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়েচে ভেলে।

করিম মিঞা এসেছেন উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলা থেকে। বছরের এই একটা সময় নয়াদিল্লিতে আসেন তিনি এক সপ্তাহের জন্য। দিল্লি জামা মসজিদের পেছনে বাড়ির উপর বাড়ি উঠে থাকা এঁদো গলির ভিতর এক চিলতে ঘর ভাড়া নিয়ে তারা চারজন আছেন।

এমনিতে সারা বছর ছাগল আর গরুর দুধ বিক্রি করে সংসার চলে করিম মিঞার। কিন্তু গোটা বছর তিনি চেয়ে থাকেন এই সময়টার দিকে। সঙ্গে আনা বিশ-বাইশটি ছাগল ভালো দামে বিক্রি হয়ে গেলে, বছরটা একটু সুখে কাটবে তার।

ভারতে সাধারণভাবে ঈদুল আজহা বকরি ঈদ নামে পরিচিত। আর বকরি ঈদ মানে পশুর বাজার। নয়াদিল্লিসহ ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর কোরবানির হাটে মূলত বিক্রি হয় ছাগল এবং মহিষ। পশ্চিমবঙ্গ ও অন্যান্য পূর্বভারতীয় রাজ্যগুলোতে ছাগল-মহিষের পাশাপাশি ভারতে গরু, দুম্বাও বিক্রি হয় প্রচুর। সময় সময়ে কোরাবানির পশুর দাম পনের-বিশ লাখ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

করিম মিঞা দিল্লির জামা মসজিদের পিছনের পশু বাজারে পসার জমিয়েছেন; কিন্তু তার মন পড়ে আছে দিল্লির বাটলা হাউস এলাকার পশুরু হাটে। কারণ কয়েক দিন আগে খবর পেয়েছেন, বাটলা হাউসের বাজার জমেছে বেশি। সেই হাটে একটি ছাগলের বিক্রি হয়েছে আড়াই লাখ রুপিতে! আড়াই লাখের সেই ছাগলটি দেখতে রীতিমতো ভিড় জমে গেছল বাটলা হাউসের সুতলি গলিতে।

অবশ্য করিম মিঞাঁর ছাগল বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ হাজার রুপি। দিল্লিতে এটাই ছাগলের গড় দাম। তবে ঈদ যত এগোবে, ছাগলের দামও বাড়তে থাকবে। ৩০ হাজার পর্যন্ত দাম তোলার ইচ্ছে আছে করিম মিঞার। নিজের মজুতে থাকা ভালো ছাগলগুলো এখনো বাজারে নামাননি তিনি।

দিল্লিতে ছাগলের বাজার যতটা বড়, মহিষের বাজার ততটা নয়। ১৪ থেকে ২০ হাজার রুপি বিক্রি হচ্ছে এক একটি মহিষ। এই দাম বড়জোর ২৫ হাজার পর্যন্ত যাবে বলে মনে করছেন মহিষ বিক্রেতারা। যাদের হাতে খুব বেশি টাকা নেই, মূলত তারাই মহিষের দিকে ঝোঁকেন। একটি মহিষ সাতজন মিলে কেনা যায়। ফলে টাকা ভাগাভাগি হয়ে যায়। অনেকে আবার জাকাত দেওয়ার জন্য মহিষ কেনেন।

জাভেদ আখতার তেমনই মানুষ।  দিল্লির যমুনা পারের বাজারে এই ক্রেতার সঙ্গে আলাপ হয় ডয়েচে ভেলের। জাভেদ জানান, ছাগল আরো কদিন পর কিনবেন, আপাতত মহিষ কিনতে এসেছেন। মহিষের মাংস বিলিয়ে দেওয়া হবে দরিদ্রসেবায়। আর বাড়ির জন্য নেবেন ছাগল।

সাত বছর আগে আগে পুরনো দিল্লির হাট থেকে একটি উট কিনেছিলেন জাভেদ। ওই একবারই উট কিনেছিলেন তিনি। এবারও পুরনো দিল্লির বাজারে দু-একটি উট এসেছে। জাভেদ উট কিনেছিলেন ৩৫ হাজার টাকায়। এবারের উট বিক্রেতারা এখনো দাম ধরেননি। বাজার আরেকটু জমলে উটের দাম জানাবেন তারা। তবে ৫০ হাজারের নিচে কোনো উট ছাড়ার ইচ্ছে নেই তাদের।

ইসলামিক স্কলার এবং জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আখতারুল ওয়েসি একসময় নয়াদিল্লির পশুবাজার নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন। ঈদুল আজহা উপলক্ষে ভারতের রাজধানীতে যে চার-পাঁচটি পশুর হাট বসে— সেসবের মোট বাণিজ্যমূল্য কত হতে পারে বলে তাকে প্রশ্ন করেছিল ডয়েচে ভেলে।

জবাবে অধ্যাপক ওয়েসি বলেন, ‘দিল্লির মান্ডি (কৃষিজাত ফসল ক্রয়ের সরকারি কেন্দ্র)গুলোতে প্রতিদিন কত টাকার কেনা-বেচা হয়, তার নির্দিষ্ট হিসেব আছে। কিন্তু ঈদের বাজারের বাণিজ্য পরিমাপ সম্ভব নয়।'

‘তার সবচেয়ে বড় কারণ, দিল্লিতে পশু বাজার যারা চালান, তারা অধিকাংশই আসেন রাজস্থান, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহার থেকে। এদের অনেকেই আবার সরাসরি পশু ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত নন। সারা বছর এ কাজ তারা করেন না। কেবলমাত্র ঈদুল আজহার সময়েই তারা গবাদি পশু নিয়ে দিল্লির পশু বাজারে চলে আসেন বিক্রি করতে। তাই নয়াদিল্লির পশু বাজার এতটাই অগোছালো যে এক কথায় মোট বাণিজ্যমূল্য নিরূপন করা প্রায় অসম্ভব। তবু যদি একটি অগোছালো হিসেবও করা যায়, তাহলে দেখা যাবে সব মিলিয়ে দুশ থেকে আড়াইশ কোটি টাকার বিক্রিবাট্টা হয় শুধু ঈদের পশুবাজারে,’ ডয়েচে ভেলেকে বলেন এই অধ্যাপক।

করিম মিঞার এবারের লক্ষ্য ঈদের বাজার থেকে অন্তত লাখ তিনেক টাকা তুলে নেওয়া। এই টাকার একটি অংশ দিয়ে নতুন পশু কিনবেন তিনি। তারপর আবার এক বছর ধরে ২০-২২টা ছাগল তৈরি করবেন পরের বছরের বাজারে নিয়ে আসার জন্য। করিম মিঞার মতো এমন হাজার হাজার বিক্রেতার দেখা মিলবে দিল্লির পশু বাজারে, বছরে এই একবারই যারা পশু বেচেন।

এই ঈদে বাজার জমে ছোট-বড় স্লটার হাউসগুলোও। এমনিতে নয়াদিল্লিতে বাইরে যেখানে সেখানে পশু জবাই নিষিদ্ধ। মূলত স্লটার হাউসগুলোতেই পশু কোরবানি হয়। সেজন্য কিছু অর্থ দিতে হয় হাউসগুলোকে। পুরনো দিল্লি, জামিয়া, বাটরা হাউস, যমুনা পারের মতো জায়গায় দেওয়ালে দেওয়ালে বিভিন্ন স্লটার হাউসের পোস্টার সাঁটা হয়েছে। বড় পশুর কোরবানি করার জন্য দুই থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত রুপি, ছোট পশু হলে এক থেকে দেড় হাজার টাকা বিল চাওয়া হচ্ছে। বছরের একটা বড় টাকা এই সময়ে কামিয়ে নেয় স্লটার হাউসগুলো। কিন্তু তাতেও কি দিল্লির রাস্তা রক্তমুক্ত থাকে?

জাভেদ বলছিলেন, কোনো কোনো সময় বকরি ঈদের পর দিনদুয়েক রাস্তায় বের হওয়া যায় না। এতটাই রক্তাক্ত থাকে গলিপথ। আখতারুল সাহেবও একই কথা বলেন। দুজনেই আঙুল তুলছেন নয়াদিল্লি সিটি কর্পোরেশনের দিকে। পশু যাতে নির্দিষ্ট জায়গাতেই কোরবানি হয়, তা দেখার দায়িত্ব নগর প্রশাসনের। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার কাজও তাদের। কিন্তু অনেক সময়েই দেখা যায়, তারা ঠিকমতো কাজ করছে না। ফলে কোরবানির পর কয়েকদিন পর্যন্ত রাস্তায় হাঁটাচলা মুশকিল হয়ে যায়।

এবছর দিল্লি পুরসভা অবশ্য বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, কোন কোন জায়গায় কোরবানি দেওয়া যাবে। জাভেদের বক্তব্য, যারা কোরবানি দিচ্ছেন, তাদেরকেও একটু সতর্ক হতে হবে। অনেক সময়েই দেখা যায়, বড় পশু নিয়ে নিয়ে দিল্লির যমুনা নদীর পাড়ে ফাঁকা জায়গা চলে যান অনেকে। সেখানে নিজেরাই কোরবানির ব্যবস্থা করেন। এই অভ্যাসগুলি বন্ধ হওয়া জরুরি।

সব মিলিয়ে জমে উঠেছে রাজধানীর ঈদের বাজার। তবে কলকাতার পশুবাজার দিল্লির চেয়ে আকারে এবং পরিমাণে অনেকটাই বড়।

এসএমডব্লিউ