পুলিশের গুলিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক তরুণের মৃত্যুর জেরে গত চার দিন ধরে বিক্ষোভ চলছে রাজধানী প্যারিসসহ ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে। ইতোমধ্যে এই বিক্ষোভ রূপ নিয়েছে দাঙ্গায়; দেশের এই পরিস্থিতির মধ্যে স্ত্রীর সঙ্গে কনসার্ট উপভোগ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।

স্ত্রী ব্রিজিতকে নিয়ে শুক্রবার রাতে প্যারিসে ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পী এলটন জনের কনসার্টে গিয়েছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। কনসার্টে তার উপস্থিতি সংক্রান্ত একটি ভিডিও ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে টুইটার, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এলটন জনের গান শুনতে শুনতে পায়ে তাল দিচ্ছেন তিনি। কনসার্টে সঙ্গীত পরিবেশনের আগে এলটন জনের সঙ্গে অল্প কিছুক্ষণ আড্ডাও দিয়েছেন ইমানুয়েল এবং ব্রিজিত।

নিজেদের সেই আলাপচারিতার ছবি এবং ভিডিও নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেছেন এলটন জন ও তার সঙ্গী ডেভিড ফারনিশ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে। একজন টুইটার ব্যবহারকারী নিজের অ্যাকাউন্টে ভিডিওটি টুইট করে ক্যাপশনে লেখেন, ‘একদিকে ফ্রান্সের শহরগুলো জ্বলছে, অন্যদিকে ম্যাক্রোঁ ও তার স্ত্রী এলটন জনের কনসার্টকে আলোকিত করছেন। তাদেরকে খুবই খুশি দেখাচ্ছে।

ফ্রান্সের পার্লামেন্টের বিরোধী দলীয় আইনপ্রণেতা থিয়েরে মারিয়ানি নিজের টুইটার অ্যাকাউন্টে প্রেসিডেন্টকে কটাক্ষ করে বলেছেন, ‘ফ্রান্স যখন জ্বলছে, তখন মন্ত্রীদের পাশে থাকার পরিবর্তে এলটন জনের গানে হাততালি দেওয়াকে জরুরি মনে করছেন প্রেসিডেন্ট।’

আরেক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘খুব ভুল সময়ে কনসার্ট উপভোগ করতে গেলেন প্রেসিডেন্ট।’

গত চারদিন ধরে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে আছে ফ্রান্স। ইতোমধ্যে ভাংচুর, নাশকতা, লুটপাট ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে রাজধানী প্যারিসসহ অন্যান্য শহর থেকে ১ হাজার ১০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে ৪৫ হাজার পুলিশ ও সাঁজোয়া যানও নামানো হয়েছে— কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত হচ্ছে না।

ফ্রান্সে এই বিক্ষোভের সূত্রপাত মঙ্গলবার থেকে। ওইদিন সকালে প্যারিসের উপশহর নানতেরে ট্রাফিক বিধি অমান্য করে জোরে গাড়ি চালানোর অভিযোগে নাহেল এম. নামের ১৭ বছর বয়সী এক তরুণ গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু নাহেল তাতে কর্ণপাত না করে গাড়ি নিয়ে সরে পড়ার চেষ্টা করলে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন পুলিশ সদস্যরা। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় নাহেলের।

নাহেলের পরিবারের সদস্যরা আলজেরিয়া থেকে এসে ফ্রান্সে স্থায়ী হয়েছেন। তাদের আর্থিক অবস্থাও খুব ভালো নয়। প্যারিসের নানতের উপশহরটি মূলত দরিদ্র অধ্যুষিত এলাকা। সেখানেই মায়ের সঙ্গে থাকতেন তিনি। নাহেল ও তার মা মৌনিয়া ইসলাম ধর্মাবলম্বী।

পুলিশের গুলিতে নাহেল নিহত হওয়ার পরই বিক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে নানতেরে। তারপর বৃহস্পতিবার বিকেলে এক অনলাইন বার্তায় নাহেলের মা মৌনিয়া তার নিহত ছেলের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি জানান। সেই সঙ্গে পাশে থাকার জন্য বিক্ষোভকারীদের ধন্যবাদও জানান তিনি।

তার এই অনলাইন বার্তা পোস্ট হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আন্দোলন তীব্র রূপ নিতে থাকে।

মূল বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল প্যারিসে। তবে বৃহস্পতিবার থেকে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বার্তাসংস্থা রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্যারিস বিক্ষোভের কেন্দ্র হিসেবে থাকলেও প্রায় একই পরিস্থিতিতে রয়েছে মার্সেইলি, লিয়ন, তুলুস, স্ট্রাসবুর্গ এবং লিলিসহ আরও কয়েকটি শহর।  

তবে দেশটির পুলিশ ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, বিক্ষোভ এখন দাঙ্গায় রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন শহরে সমানে পুলিশকে লক্ষ্য করে হামলা, সরকারি-বেসরকারি ভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, দোকানপাট লুটপাট এবং যানবাহন জ্বালিয়ে দিচ্ছে দাঙ্গাকারীরা। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দিনে ফ্রান্সজুড়ে ২ হাজারেরও বেশি যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।

শুক্রবার একটি ফরাসি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, দাঙ্গায় নাশকতামূলক কর্মকান্ড ও পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তারের সংখ্যা ১ হাজার ১০০ জন ছাড়িয়ে গেছে এবং তাদের সবারই গড় বয়স ১৭।

এসএমডব্লিউ